নিউজ ডেস্ক: ভারতের রাজধানী দিল্লির বিভিন্ন এলাকায় শনিবার সকালে লাখ লাখ পঙ্গপাল ঢুকে পড়েছে। দিল্লি লাগোয়া গুরগাঁওয়ের ওপর দিয়ে পঙ্গপালের দল উড়ে যায়।
কোনো ক্ষতি তারা করেনি গুরগাঁও বা দিল্লির, কিন্তু যেদিকে তাদের যেতে দেখা গেছে, সেই উত্তরপ্রদেশে ফসলের বড়সড় ক্ষতি তার করতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
বেলা তখন এগারোটা পনেরো। গুরগাঁওয়ের বহুতলের পনেরো তলার ঘরে বন্ধুর সঙ্গে কথা বলছিলেন জয় ভট্টাচার্য। হঠাৎই তিনি একটানা ঝিঁঝি পোকার ডাকের মতো, কিন্তু তার থেকে কয়েক শ’ গুন জোরালো শব্দ শুনতে পেয়েছিলেন।
”তারপরে জানলা দিয়ে তাকিয়ে দেখি হাজারে হাজারে পঙ্গপাল ঠিক জানলার বাইরেই। আমার বন্ধুও গুরগাঁওতেই থাকে। ওকে বলি দেখ, পঙ্গপাল হানা দিয়েছে আমাদের এখানে। তাড়াতাড়ি জানলা, দরজা সব বন্ধ করে দিয়েছিলাম। খুব ভালোই জানি একবার ঘরে ঢুকে পড়লে বিপদ হবে।
”তারপরে আমি যখন ছবি তুলতে শুরু করি, আকাশে যেন হলুদ রঙের মেঘ ছেয়ে গেছে আর একটানা শব্দ। ক্যামেরার লেন্সে কারও আঙ্গুলের ছাপ পড়লে যেরকম আবছা হয়ে যায়, সেরকম ছিল ব্যাপারটা।”
“যে পোকাগুলো জানালার কাছে চলে এসেছিল, সেগুলো দেখছিলাম বেশ বড়ো। কিন্তু দু-একটা ছাড়া কোনোটাই নিচের দিকে নামছিল না। প্রায় মিনিট দশ পনেরো ধরে ওগুলো দিল্লির দিকে চলে গেল,” বলছিলেন ভট্টাচার্য।
তবে গোটা গুরগাঁওয়ের মানুষ এই দৃশ্য দেখতে পাননি। একটি নির্দিষ্ট এলাকা দিয়েই পার হয়েছে পঙ্গপালের দল। ওই দৃশ্য ক্যামেরা বন্দী করেছেন অনেক মানুষ আর সামাজিক মাধ্যমে তা ভরে গেছে।
গুরগাঁওয়ের আরেক বাসিন্দা কৌশিক মুখার্জী তখন বাড়ির বাইরেই ছিলেন।
“আমি কিন্তু দেখতে পাইনি পঙ্গপালের হানা। যে অঞ্চল দিয়ে গেছে বলে পরে শুনলাম, তার কাছেই ছিলাম আমি। বাড়িতে ফিরে হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপগুলো থেকে জানতে পারলাম যে বেশ কাছাকাছি দিয়েই গেছে পঙ্গপাল। অনেক ছবি আর ভিডিও এসেছে আমার বাড়ির কাছাকাছি প্রতিবেশীরাই পাঠিয়েছেন। অনেকে সাবধান হতে বলেছেন। কিন্তু সরকারীভাবে আগে থেকে কোনও সতর্ক বার্তা কিন্তু আমার কাছে আসেনি,” বলছিলেন কৌশিক মুখার্জী।
হরিয়ানার ঝর্ঝর থেকে যে পঙ্গপালের দল গুরগাঁও আর দিল্লির দিকে আসছে, সেটা শুক্রবার রাতেই বোঝা গিয়েছিল।
এরা হাজার হাজার কিলোমিটার অতিক্রম করে কয়েক দশক পর পর উড়ে আসে খাবারের খোঁজে। মানুষের ক্ষতি না করলেও ফসলের ব্যাপক ক্ষতি করে এই পঙ্গপালের দল।
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের পতঙ্গবিজ্ঞানের অধ্যাপক অম্লান দাস ব্যাখ্যা করছিলেন, “এই পঙ্গপালের হানাকে প্লেগ বলা হয়। কয়েক দশক পর পর এরা আসে মধ্যপ্রাচ্য থেকে পাকিস্তান হয়ে রাজস্থানে ঢোকে এরা। ক’দিন ধরেই রিপোর্ট পাওয়া যাচ্ছিল যে গুরগাঁও, দিল্লি এই অঞ্চল দিয়ে যাবে এরা। মূলত ভূট্টা, গম, ধানের মতো ফসল খেতে এরা ভালবাসে। আবার উষ্ণ এবং আর্দ্র অঞ্চলও চাই এদের। যদি একটা প্যাটার্ন দেখেন, তাহলে দিল্লির পর এরা গঙ্গা অববাহিকা অঞ্চল, অর্থাৎ উত্তরপ্রদেশ, বিহার হয়ে পশ্চিমবঙ্গ পর্যন্তও আসতে পারে।”
“তবে সেটা থিওরিটিক্যালি। এতদূর এরা নাও আসতে পারে। কারণ পঙ্গপাল ডানা গজানোর পরে গড়ে ৩৬ থেকে ৪০ দিন বাঁচে। এই যে দলগুলো, হানা দিয়েছে তারা আগে থেকেই উড়ছে। আর গড়ে প্রতিদিন ১০০ কিলোমিটার মতো উড়তে পারে ওরা। সূর্যোদয় আর সূর্যাস্তের আগে পরেই এরা ওড়ে। সেই হিসাব করলে আরো দিন পনেরো লাগতে পারে পশ্চিমবঙ্গে আসতে। কিন্তু ততদিন এত পঙ্গপাল জীবিত থাকবে কী না, সেটা বলা কঠিন,” ব্যাখ্যা করছিলেন অধ্যাপক দাস।
গুজরাত আর রাজস্থানে সরকারি গবেষণাগার আছে, যারা পঙ্গপালের হানা নিয়ে আগাম সতকর্তা দেয়। সেই অনুযায়ী প্রশাসন সাধারণ মানুষকে সতর্কও করেছিল। বলা হয়েছিল দরজা জানলা বন্ধ রাখতে, আর থালা বাটি বাজিয়ে শব্দ করতে, যাতে পঙ্গপালের দল দূরে সরে যায়। তৈরি রাখা হয়েছে পতঙ্গনাশক স্প্রে।
“শব্দ করা বা সাইরেন বাজালে অথবা গাড়ির হর্ণ বাজালে পঙ্গপাল সরে যায়, আর পতঙ্গনাশক ওষুধও স্প্রে করা যায়। এখন তো ড্রোন ব্যবহার করা হচ্ছে। সবটাই করতে হয় রাতের বেলা, যখন পঙ্গপাল গাছের ভেতরের দিকে ঢুকে আশ্রয় নেয়। ওরা রাতে উড়তে পারে না,” বলছিলেন ইন্ডিয়ান এগ্রিকালচারাল রিসার্চ ইনস্টিটিউটের পতঙ্গবিজ্ঞান বিভাগের প্রাক্তণ প্রধান গোভিন গুজার।
কীভাবে পঙ্গপালের আক্রমণ থেকে ফসল বাঁচানো যায়, তা নিয়ে গবেষণা করেছেন তিনি।
গুজারের কথায়, “গবেষণায় দেখা গেছে কৃষক যদি জৈব পদ্ধতিতে ফসল রক্ষা করতে চান, তাহলে নিম ফল থেকে তৈরি ওষুধও ব্যবহার করতে পারেন।”
গুরগাঁও একেবারেই দিল্লির লাগোয়া, তাই ওই পঙ্গপালের প্লেগ যদি রাজধানীতে হানা দেয়, তাহলে কীভাবে পরিস্থিতি সামাল দেওয়া যাবে, তা নিয়ে জরুরি বৈঠকে বসেছে দিল্লি প্রশাসন।
গুরগাঁওয়ের পাশেই দিল্লির আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর। দিল্লির এয়ার ট্র্যাফিক কন্ট্রোল সব বিমানের পাইলটদের সতর্ক থাকার নির্দেশ দিয়েছে।
সূত্র : বিবিসি