ড. আহসান উল্লাহ ফয়সাল
একটি বই পাঠ করে জানতে পেরেছি যে ফ্রান্সের ৯০ শতাংশ সরকারের বিভিন্ন আইন ইমাম মালেক (রহ.)-এর মাজহাবের বই থেকে নেওয়া। ১৯২৫ সালে মিসরের সৈয়দ আবদুল্লাহ হাসান ফ্রান্সে গিয়ে লিসান্স পাস করে সেখানে ১০ বছর বিচারপতির দায়িত্ব পালন করেন। পরে তিনি মিসরের বিচারপতি ও মন্ত্রী হন। আট বছর কষ্ট করে ১৯৪৮ সালে তিনি comparative Fiqh or jurisprudence-এর ওপর একটি বই লিখেন। এখানে তিনি প্রমাণ করেছেন যে ফ্রান্সের শতকরা ১০ ভাগের ৯ ভাগ আইন মিসর ও তিউনিসিয়ার মালেকি মাজহাব থেকে নেওয়া হয়েছে। তিনি কোথায় কোথায় মিল রয়েছে, তা পরিপূর্ণরূপে তুলে ধরেন।
এটা কিভাবে সম্ভব হলো?
ক.
১০০৩ খ্রিস্টাব্দে রোমের পোপ Sylveste মুসলিমদের অধীনে থাকা স্পেনের কর্ডোভার মাদরাসা থেকে অনেক বই নিয়ে আসেন। প্রাচীন গ্রিক ও রোমানদের আইনের দর্শন, নৈতিক ভিত্তি দুর্বল ও সময় উপযোগী নয় বলে তিনি ফ্রান্স ও ইতালিতে অনেক আইন নতুন আইন হিসেবে কোডিফিকেশন করেন। তখন ইউরোপে ৯০ শতাংশ লোক ছিল অশিক্ষিত। শুধু ০১—১০ শতাংশ মানুষ ছিল শিক্ষিত। তাও আবার গ্রিস ও এথেন্সকেন্দ্রিক। আর কর্ডোভার এক শহরে মুসলিমদের ১৮টি বিশ্ববিদ্যালয় ছিল।
খ.
ফ্রান্সের William the conquerer/bustard (1027-1066) ব্রিটেন দখল করে ইসলামের সাক্ষ্য, ট্রানজেকশন ও শিরকত আইনসহ অনেক আইন জারি করেন। আর নাগরিকদের অধিকার দেওয়ার ঘোষণা (১২১৫ খ্রিস্টাব্দ) megna Carta-এর আগে ব্রিটেনে কোনো বিধিবদ্ধ আইন ছিল না। যা ছিল তা হলো, ইউজেজ, কাস্টম, ব্যবহার আর উইলিয়ামের চাপানো আইন। (এ ছাড়া নিচের গুরুত্বপূর্ণ ইংরেজি লেখাটি দেখতে পারেন ব্রিটেনের ব্যাপারে-
Professor John Makdisi’s article : “The Islamic Origins of the Common Law” in the North Carolina Law Review theorized that English common law was influenced by medieval Islamic law. Makdisi drew comparisons between the “royal English contract protected by the action of debt” and the ‘Islamic Aqd’, the ‘English assize of novel disseisin’ (a petty assize adopted in the 1166 at the Assizes of Clarendon) and the ‘Islamic Istihqaq’, and the ‘English jury’ and the ‘Islamic Lafif’ in the classical Maliki school of Islamic jurisprudence, and argued that these institutions were transmitted to England by the Normans, ‘through the close connection between the Norman kingdoms of Roger II in Sicily—ruling over a conquered Islamic administration—and Henry II in England.’ Makdisi also argued that the ‘law schools known as Inns of Court’ in England (which he asserts are parallel to Madrasahs) may have also originated from Islamic law. He states that the methodology of legal precedent and reasoning by analogy (Qiyas) are also similar in both the Islamic and common law systems.Other legal scholars such as Monica Gaudiosi, Gamal Moursi Badr and A. Hudson have argued that the English trust and agency institutions, which were introduced by Crusaders, may have been adapted from the Islamic Waqf and Hawala institutions they came across in the Middle East. Paul Brand also notes parallels between the Waqf and the trusts used to establish Merton College by Walter de Merton, who had connections with the Knights Templar.) এখন প্রতীয়মান হলো, ব্রিটেনে ১৭৫০ সালের পর আইনের উৎকর্ষতা সাধিত হয়, এর আগে নয়—বলেছেন দুজন আইন বিশেষজ্ঞ।
গ.
একাদশ-দ্বাদশ শতকে ক্রসেড যুদ্ধের সময় খ্রিস্টানরা বায়তুল মুকাদ্দিস, ফিলিস্তিন, সিরিয়া ও জর্দান দখল করে। পরে সালাহউদ্দিন আইয়ুবি (রহ.) ও নূর উদ্দিন জঙ্গি (রহ.) তা উদ্ধার করেন। খ্রিস্টানরা পরাজিত হলেও সঙ্গে নিয়ে যান আরব অঞ্চলের মতো বিচারভিত্তিক ফিকাহের আইন-কানুন। শিয়া ছাড়া বাকি চার মাজহাবের আইন নিয়ে যান। এটাকে কোডিফাইড করে ফ্রান্স, সিসিলি ও ইটালির কিছু অঞ্চলে।
ঘ.
ফ্রান্সের সমরনায়ক ও রাষ্ট্রপতি নেপোলিয়ন বোনাপার্ট ১৮০৩ সালে মিসর দখল করে যাওয়ার সময় মালেকি মাজহাবের একটি আইনের বই নিয়ে তা অনুবাদ করিয়ে তার দেশে অনেক আইনের ধারা সংযোজন করেন। ফ্রান্সের বিখ্যাত ঐতিহাসিক গুস্তাফ লুবুন বলেন, তিনি (নেপোলিয়ন) ১৮০১ সালে ইমাম মালেকের বই ‘শারহুদ দারদীর আলা মাতানিল খলীল’ নিয়ে ফ্রান্সে কার্যকর করেন।
ঙ.
অন্যদিকে তুর্কি উসমানীয়রা রাশিয়ার ছয় মুসলিম প্রজাতন্ত্র, চীনের ঝিংঝিআং, বুলগেরিয়া, আলবেনিয়া ও বসনিয়া এবং গ্রিস-এথেন্স-সাইফ্রাসে ইসলামী ফিকাহ চালু করে ধরে রাখেন তিন শ থেকে পাঁচ শ বছর।
১৯৫৬ সালে আন্তর্জাতিক কোর্টের প্রধান আন্তর্জাতিক আইন কনফারেন্সে আরব ও ইসলামী জুরিসপ্রুডেন্স পড়ার আহ্বান জানান। ব্রিটেন আমেরিকা দখলের পর কিছু আইন চালু করে, যার মধ্যে ইসলামী আইনের নৈতিক দর্শনের কিছু জিনিস পাওয়া যায়।
আর ইসলামী ফিকাহের প্রভাব এশিয়া ও আফ্রিকায় তো ছিল এবং বর্তমানে আছেই। তবে আজকে যেমন ফ্রান্সসহ পশ্চিমা দেশগুলোতে ইসলামভীতি (Islamic phobia) সক্রিয়, তেমনি মুসলিম দেশে ইসলামী ফিকাহের প্রভাব বেশ কিছু ক্ষেত্রে থাকলেও সব ক্ষেত্রে নেই।
প্রতিটি জাতির jurisprudence তার ঐতিহ্য ও সম্পদ। ইসলামী ফিকাহও মুসলিম জাতির মস্তবড় সম্পদ। এতে মানবিক অধিকার, দর্শন, সামাজিক নিরাপত্তা ও ন্যায়বিচার সুরক্ষিত।
আল্লাহ সব মুসলিমকে বোঝার তাওফিক দিন।
লেখক : প্রফেসর, দাওয়াহ অ্যান্ড ইসলামিক স্টাডিস বিভাগ, ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়া