নিউজ ডেস্ক: অবৈধভাবে সীমান্ত পাড়ি দিয়ে দেশ ছেড়ে পালাচ্ছিলেন দুই ধর্ষক এম সাইফুর রহমান ও অর্জুন লস্কর। একজন সুনামগঞ্জ ছাতকের সুরমা নদী পাড়ি দিয়ে সীমান্তের বেশ কাছাকাছি পৌঁছেছিলেন। অপরজন হবিগঞ্জ মাধবপুরের সীমান্তবর্তী গ্রাম মনতলায় ঘাপটি মেরে বসেছিলেন নির্ধারিত সময়ের অপেক্ষায়। কিন্তু তাদের সেই সীমান্ত পাড়ি দেওয়া হয়নি। পুলিশের দল সময়মতো ঠিকই পৌঁছে যায় তাদের ডেরায়। সিলেটের এমসি কলেজ ছাত্রাবাসে স্বামীকে বেঁধে স্ত্রীকে গণধর্ষণের ঘটনার অন্যতম দুই নায়ক ছাত্রলীগের এই দুই ক্যাডার সাইফুর এবং অর্জুনকে গতকাল এভাবেই গ্রেফতার করে পুলিশ। পুলিশ জানিয়েছে, তারা দুজনই অবৈধভাবে সীমান্ত অতিক্রম করে ভারত যাওয়ার চেষ্টা করছিলেন। এ ছাড়া এদিন সন্ধ্যায় হবিগঞ্জের শায়েস্তাগঞ্জ থেকে আরও দুই আসামিকে গ্রেফতার করেছে র্যাব ও পুলিশ। তারা হলেন- শাহ মাহবুবুর রহমান রনি ও রবিউল ইসলাম। মামলার এজাহারনামীয় বাকি দুই আসামি এখনো পলাতক রয়েছেন। এদিকে গতকাল আদালতে জবানবন্দি দিয়েছেন ধর্ষিতা। ধর্ষণের ঘটনার প্রতিবাদে সিলেটজুড়ে এদিনও বিক্ষোভ হয়েছে। ধর্ষকসহ সব ধরনের বখাটের বিরুদ্ধে ওয়ার্ডে ওয়ার্ডে প্রতিরোধ গড়ে তোলার আহ্বান জানিয়েছেন সিটি মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী।
নদী পারাপারের সময় ধরা পড়েন সাইফুর : দাড়ি কেটে নিজের চেহারায় পরিবর্তন আনেন গণধর্ষণের মূলহোতা সাইফুর রহমান। গতকাল সকালে সুনামগঞ্জের ছাতক বাজার দিয়ে সুরমা নদী পার হয়ে নোয়ারাই পৌঁছান তিনি। কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি তার। গোপন সংবাদের ভিত্তিতে সেখানে ওতপেতে ছিল ছাতক থানার এসআই হাবিবুর রহমানের নেতৃত্বে পুলিশের একটি দল। নোয়ারাই পৌঁছার পর পুলিশ সাইফুরকে গ্রেফতার করে। কিন্তু দাড়ি কেটে চেহারায় পরিবর্তন আনায় সাইফুরের পরিচয় নিয়ে বিপাকে পড়ে পুলিশ। শুরুতে সাইফুরও পুলিশকে বিভ্রান্ত করে। পরে থানায় এনে জিজ্ঞাসাবাদের একপর্যায়ে সাইফুর তার নিজের পরিচয় দিয়ে বলেন, তিনি ধর্ষক সাইফুর। পরে তাকে সিলেটের শাহপরান থানা পুলিশের কাছে হস্তান্তর করা হয়। সাইফুর রহমান সিলেটের বালাগঞ্জ উপজেলার চান্দাইপাড়ার তাহিদ মিয়ার ছেলে। এমসি কলেজে পড়ালেখা শেষ হলেও তিনি ছাত্রাবাসের নতুন ভবনের ২০৫ নম্বর কক্ষ ও হোস্টেল সুপারের বাংলো দখল করে থাকতেন। পুলিশের জেরায় সাইফুর জানিয়েছেন, ছাতকে সুরমা নদী পাড়ি দিয়ে নোয়ারাই হয়ে প্রথমে বাংলাবাজার ও পরে সেখান থেকে দোয়ারাবাজার সীমান্ত দিয়ে ভারতে পালানোর পরিকল্পনা ছিল তার। কিন্তু পরিকল্পনা বাস্তবায়নের আগেই পুলিশের হাতে ধরা পড়তে হয় তাকে।
ভারত সীমান্তের কাছাকাছি অবস্থান করছিলেন অর্জুন : গতকাল ভোর সাড়ে ৫টার দিকে সীমান্ত পাড়ি দেওয়ার প্রস্তুতি নেওয়ার সময় সিলেট জেলা গোয়েন্দা পুলিশের একটি দল তাকে গ্রেফতার করে। অর্জুন লস্কর সিলেটের জকিগঞ্জ উপজেলার আটগ্রামের কানু লস্করের ছেলে। তিনি এমসি কলেজ ক্যাম্পাসের পাশর্^বর্তী রাজপাড়ায় একটি ভাড়া বাসায় থাকতেন। পুলিশ জানায়, গণধর্ষণের ঘটনার পরই সিলেট থেকে পালিয়ে যান মামলার ৪ নম্বর আসামি অর্জুন লস্কর। আশ্রয় নেন হবিগঞ্জ জেলার মাধবপুর উপজেলার মনতলা দুর্লভপুর সীমান্ত এলাকায় এক আত্মীয়ের বাড়িতে। সেখানে তিনি অপেক্ষায় ছিলেন সিগন্যালের। সিগন্যাল পেলেই তার সীমান্ত পাড়ি দেওয়ার কথা ছিল।
শায়েস্তাগঞ্জ থেকে দুই আসামি গ্রেফতার : গতকাল সন্ধ্যায় হবিগঞ্জে পৃথক অভিযান চালিয়ে র্যাব ও পুলিশ শাহ মাহবুবুর রহমান রনি ও রবিউল ইসলামকে গ্রেফতার করেছে। তাদের মধ্যে শায়েস্তাগঞ্জ থেকে র্যাব-৯ এর একটি দল অভিযান চালিয়ে মামলার ৩ নম্বর আসামি শাহ মাহবুবুর রহমান রনিকে গ্রেফতার করে। আর নবীগঞ্জে পুলিশ অভিযান চালিয়ে অন্যতম আসামি রবিউল ইসলামকে গ্রেফতার করে।
এখনো অধরা দুই আসামি : গতকাল সন্ধ্যা ৭টায় এ প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত গণধর্ষণ মামলার এজাহারনামীয় দুই আসামি পলাতক রয়েছেন। তথ্য প্রযুক্তি ব্যবহার করেও তাদের অবস্থান শনাক্ত করতে পারেনি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। তবে তাদের গ্রেফতারে সিলেট বিভাগের সম্ভাব্য কয়েকটি স্থানে অভিযান চালিয়েছে র্যাব ও পুলিশ। পলাতক থাকা আসামিরা হলেন- সুনামগঞ্জ সদরের নিসর্গ-৫৭ নম্বর বাসার মৃত রফিকুল ইসলামের ছেলে তারেকুল ইসলাম তারেক, সিলেটের কানাইঘাট উপজেলার গাছবাড়ির মাহফুজুর রহমান মাসুম।
আদালতে ধর্ষিতার জবানবন্দি রেকর্ড : শুক্রবার রাতে সিলেট এমসি কলেজ ছাত্রাবাসে গণধর্ষণের রোমহর্ষক ঘটনার বর্ণনা দিয়েছেন ধর্ষিতা গৃহবধূ। গতকাল বেলা দেড়টার দিকে সিলেট মহানগর হাকিম তৃতীয় আদালতের বিচারক শারমিন খানম নীলা তার জবানবন্দি রেকর্ড করেন। জবানবন্দিতে ধর্ষিতা ক্যাম্পাস থেকে স্বামীসহ তাকে তুলে নেওয়া, ছাত্রাবাসে তার স্বামীকে আটকে রাখা এবং গাড়ির ভিতর একের পর এক ধর্ষণের ঘটনার বর্ণনা দেন তিনি। বর্বর এই ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে ওই গৃহবধূ বারবার কান্নায় ভেঙে পড়ছিলেন বলে জানা গেছে।
প্রতিরোধ গড়ে তোলার আহ্বান : এমসি কলেজের ছাত্রাবাসে গৃহবধূ গণধর্ষণের ঘটনায় সিলেট সিটি করপোরেশনের কাউন্সিলরদের সঙ্গে নিয়ে মহানগর পুলিশ কমিশনারের সঙ্গে বৈঠক করেছেন সিটি মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী। গতকাল বেলা ১টার দিকে পুলিশ কমিশনার কার্যালয়ে এ বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকে এ ধরনের অপকর্ম প্রতিরোধে তিনি পাড়া-মহল্লায় গণপ্রতিরোধ গড়ে তুলতে নগরবাসীর প্রতি আহ্বান জানান।
প্রশ্নবিদ্ধ কলেজের তদন্ত কমিটি : গণধর্ষণের ঘটনার পর তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করেছে এমসি কলেজ কর্তৃপক্ষ। কলেজের গণিত বিভাগের প্রধান আনোয়ার হোসেন চৌধুরীকে আহ্বায়ক করে গঠিত কমিটিতে সদস্য রাখা হয়েছে হোস্টেল সুপার জামাল উদ্দিনকে। কিন্তু গণধর্ষণের ঘটনার পর দায়িত্ব অবহেলার অভিযোগ ওঠে কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক সালেহ উদ্দিন আহমদ ও হোস্টেল সুপার জামাল উদ্দিনের বিরুদ্ধে। করোনা পরিস্থিতিতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকাবস্থায় ছাত্রলীগ নেতা-কর্মীরা কীভাবে হোস্টেলে অবস্থান করে- এমন প্রশ্নের জবাবে শুধু নিজেদের অসহায়ত্ব প্রকাশ করেছেন অধ্যক্ষ ও হোস্টেল সুপার। এই অসহায়ত্ব নিয়ে জামাল উদ্দিন কতটুকু প্রভাবমুক্ত তদন্ত করতে পারবেন তা নিয়ে দেখা দিয়েছে নতুন প্রশ্ন। গণধর্ষণের ঘটনার মূলহোতা সাইফুর রহমানের কাছে নিজেই অসহায় ছিলেন হোস্টেল সুপার জামাল উদ্দিন। তার বাংলো দখল করে রেখেছিলেন সাইফুর রহমান। সেখানে জুয়া ও মাদকের আসর বসাতেন তিনি। এ ছাড়া গণধর্ষণের ঘটনার পর হোস্টেলের দুই নিরাপত্তারক্ষীকে বরখাস্ত করা হলেও বহাল থেকে যান হোস্টেল সুপার। উল্টো তাকে তদন্ত কমিটির সদস্য করায় কমিটির ভবিষ্যৎ কার্যক্রম নিয়ে আগাম প্রশ্ন দেখা দিয়েছে।
প্রতিবাদ ও বিক্ষোভ : এমসি কলেজে গণধর্ষণের ঘটনার প্রতিবাদে সিলেটে গতকালও বিক্ষোভ হয়েছে। বিকালে কলেজ ছাত্রাবাসের সামনে মানববন্ধন ও প্রতিবাদ সমাবেশ করে ‘সংক্ষুব্ধ নাগরিক সমাজ’। দুপুরে এমসি কলেজে গণধর্ষণের ঘটনার প্রতিবাদে এবং জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির প্রতিবাদে মানববন্ধন ও প্রতিবাদ সমাবেশ করেছে ছাত্রলীগ ও সাধারণ শিক্ষার্থীরা।
তারা গণধর্ষণের ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের দ্রুত গ্রেফতার করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিয়ে এমসি কলেজকে কলঙ্কমুক্ত করার দাবি জানান।
প্রসঙ্গত, গত শুক্রবার সন্ধ্যায় এমসি কলেজ ক্যাম্পাসে বেড়াতে আসা এক দম্পতিকে তুলে নেন ছাত্রলীগ ক্যাডাররা। পাশর্^বর্তী ছাত্রাবাসে নিয়ে স্বামীকে বেঁধে স্ত্রীকে গণধর্ষণ করে তারা। এ ঘটনায় পরদিন ধর্ষিতার স্বামী বাদী হয়ে শাহপরান থানায় ছাত্রলীগের ছয়জনের নাম উল্লেখ করে অজ্ঞাত আরও তিনজনকে আসামি করে থানায় মামলা করেন।