নিউজ ডেস্ক: কক্সবাজারের টেকনাফে ভিডিও চিত্র ধারণ করতে গিয়েই থানার ওসি প্রদীপ কুমার দাশ, পরিদর্শক লিয়াকত আলীর টার্গেটে পড়েন মেজর (অব.) সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খান। ঘটনার দিন বিকেলে তিনি সহযোগী সাহেদুল ইসলাম সিফাতকে নিয়ে টেকনাফ থানা এলাকা, বাহারছড়ার নোয়াখালীপাড়া ও মারিসঘোণা এলাকায় বেশ কিছু দৃশ্য ধারণ করেন। ধারণা করা হচ্ছে, এই কাজের ফাঁকে সিনহা রাশেদ ইয়াবা কারবারে প্রদীপের সিন্ডিকেটসহ স্পর্শকাতর কিছু প্রমাণ পেয়ে যান। সিনহা নিহত হওয়ার পর তাঁর ভিডিওসংশ্লিষ্ট আলামতগুলো গায়েব হওয়ায় এ ব্যাপারে ব্যাপক সন্দেহ তৈরি হয়েছে।
পুলিশের পক্ষ থেকে টেকনাফ ও রামু থানায় দায়ের করা দুটি মামলার এজাহার ঘেঁটে দেখা গেছে, সেখানে নেই সিনহার শুটিং টিমের ল্যাপটপ ও ক্যামেরার মেমোরি কার্ড। এসব ডিভাইসে স্পর্শকাতর ভিডিও চিত্র বা মামলার গুরুত্বপূর্ণ আলামত গায়েব করা হয়েছে বলে ধারণা করছেন সংশ্লিষ্টরা।
এদিকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে একটি সংবাদ ছড়িয়ে পড়েছে যে সিনহা ওসি প্রদীপের বক্তব্যসহ কিছু ভিডিও রেকর্ড করার কারণে তাঁকে অনুসরণ করে হত্যা করা হয়। বলা হচ্ছে, চলচ্চিত্রের ফাইটিং গ্রুপ পরিচালনাকারী অভিনেতা ইলিয়াস কোবরার সঙ্গে ঘটনার দিন ওসি প্রদীপ ও লিয়াকতের কয়েকবার যোগাযোগ হয়। ওই দিন বিকেলে মেজর সিনহাকে আমন্ত্রণ জানিয়ে মেরিন ড্রাইভের পাশে বাড়িতে ডেকে সময়ক্ষেপণ করেন ইলিয়াস কোবরা।
তবে এসব অভিযোগ সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন বলে দাবি করেন ইলিয়াস কোবরা। তিনি বলেন, ‘একটি বস্তা উদ্ধারের ঘটনায় একজনকে আটক করা হলে তিনি লিয়াকতের সঙ্গে ফোনে কথা বলেন।’ সেই বস্তার সন্ধান করতে গিয়ে কেঁচো খুঁড়তে গিয়ে সাপ বের হওয়ার মতো ঘটনা জানা গেছে। সেই রাতে মেরিন ড্রাইভের নোয়াখালীপাড়া সৈকতে বিপুল পরিমাণ ‘আইস’ (নতুন ধরনের মাদক) উদ্ধার হলেও তা গায়েব করে দেন ওসি প্রদীপ ও লিয়াকতরা। এই ঘটনার সঙ্গে সিনহা হত্যার যোগসূত্র আছে কি না সেটাও সন্দেহ করছে এলাকাবাসী। ঘটনার দিন সিনহা রাশেদ কোথায় কোথায় গেছেন এবং ভিডিওতে কী ধারণ করেছেন—তা তদন্তে গুরুত্বপূর্ণ মোড় ঘোরাতে পারে বলে মনে করছেন অনেকে।
পুলিশের মামলায় সিনহা রাশেদ ও সিফাতের কাছ থেকে ২১ রকমের আলামত জব্দ দেখানো হয়েছে। এগুলো হলো একটি বিদেশি পিস্তল, পিস্তলের কাভার, ৯ রাউন্ড গুলি, ৫০ পিস ইয়াবা, ২৫০ গ্রাম গাঁজা, মানিব্যাগ, দুটি পরিচয়পত্র, দুটি মোবাইল ফোন, একটি ব্লুটুথ ডিভাইস, ছুরি, স্ক্রু ডাইভার সংবলিত ছুরি, দুটি কালো রঙের মাস্ক, একটি ক্যানন ব্রান্ডের ডিএসএলআর ক্যামেরা, ৯টি ডিস্কের একটি ডিসি বক্স, একটি সেনাবাহিনীর ক্যাপ, একটি গাড়ির ম্যানুয়াল বই, দুটি কাঁধের ব্যাগ, একটি ড্রাইভিং লাইসেন্স, গাড়ির রেজিস্ট্রেশন, তিনটি ব্যাংকের ভিসা কার্ড, একটি মাস্টার কার্ড এবং সিলভার রঙের এলিয়ন গাড়ি।
সংশ্লিষ্টরা জানান, ডিএসএলআর ক্যামেরায় মেমোরি কার্ড থাকে। তবে জব্দ তালিকায় কার্ডের ব্যাপারে কিছু উল্লেখ করা হয়নি। এদিকে রামু থানায় শিপ্রার বিরুদ্ধে করা মাদকের মামলায় অন্য কোনো জিনিসপত্র জব্দ দেখানো হয়নি। তবে জানতে চাইলে রামু থানার ওসি মো. আবুল খায়ের বলেন, সিনহার কক্ষ থেকে প্রাপ্ত মাত্র তিনটি জিনিস রামু থানা পুলিশ পৃথকভাবে জমা রেখেছে। একটি ল্যাপটপ, একটি অস্ত্রের লাইসেন্স ও এক জোড়া জুতা সেখানে রয়েছে। যথাযথ কর্তৃপক্ষের অনুমতি পেলে সেই সব জিনিস ফেরত দেওয়া হবে।
স্বজন ও তদন্তকারীরা বলছেন, হত্যা মামলার আসামি পুলিশ সদস্যরা সিনহার কাছে থাকা ক্যামেরা ও ল্যাপটপে স্পর্শকাতর বা গোপনীয় কিছু থাকলে তা সরিয়ে নিয়েছেন বা নষ্ট করেছেন। এ কারণেই জব্দ তালিকায় পরিষ্কারভাবে ল্যাপটপ এবং ক্যামেরার মেমোরি কার্ড দেখানো হয়নি। সিনহা যদি ইয়াবা কারবারসহ কোনো অপকর্মের ব্যাপারে প্রমাণসহ ভিডিও ধারণ করেন, তবে সেগুলো এই দুটি ডিভাইসেই সংরক্ষিত থাকবে। জানতে চাইলে হত্যা মামলার বাদী ও সিনহা রাশেদের বোন শারমিন শাহরিয়া ফেরদৌস কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘তাঁর (সিনহা) ব্যাকপ্যাকে ক্যামেরা, ল্যাপটপ থাকত। কী কী মিসিং আমরা যাচাই করার সুযোগ পাইনি।’
সিফাতের খালু মাসুম বিল্লাহ বলেন, ‘সিফাতের সঙ্গে থাকা জিনিসপত্র কোথায় আছে তা জানা যায়নি। সে আমাদের সঙ্গে অল্প একটু কথা বলতে পেরেছে। সেখানে সে বলেছে, তার সঙ্গে মোবাইল ফোন, ক্যামেরা এসব ছিল।’
জানতে চাইলে র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক লে. কর্নেল আশিক বিল্লাহ কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে যেসব বিষয় এসেছে, তা আমাদেরও নজরে এসেছে। তা ছাড়া মিডিয়াতে যেগুলো আসছে সবই আমলে নিয়ে তদন্ত করছি। এগুলো খতিয়ে দেখা হবে।’ তিনি আরো বলেন, চার আসামিকে গতকাল জেলগেটে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। সাবেক ওসি প্রদীপ কুমারসহ দুই আসামিকে আজ সোমবার রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু হবে। আরেক আসামিকে পরে নেওয়া হবে বলে জানান তিনি।
দৃশ্যপটে ইলিয়াস কোবরা : সিনহা রাশেদকে যেদিন (৩১ জুলাই) গুলি করে হত্যা করা হয় সেদিন চলচ্চিত্রে খল চরিত্রের অভিনেতা ইলিয়াস কোবরার সঙ্গে বাহারছড়া তদন্ত কেন্দ্রের পরিদর্শক লিয়াকত আলীর কয়েকবার ফোনে যোগাযোগ হয় বলে শোনা যাচ্ছে। ইলিয়াসের বাড়ি মেরিন ড্রাইভের পাশে বাহারছড়া ইউনিয়নের ৯ নম্বর ওয়ার্ডের নোয়াখালীপাড়ায়। ফেসবুকে প্রকাশ পেয়েছে, ওসি প্রদীপ ও পরিদর্শক লিয়াকতের ঘনিষ্ঠ ইলিয়াস কোবরা নিহত সিনহা রাশেদকে আমন্ত্রণ করে তাঁর বাড়িতে নিয়ে কালক্ষেপণ করান। তাঁর কাছ থেকে চলে যাওয়ার পর তাঁর দেওয়া তথ্যেই অনুসরণ করে সিনহাকে হত্যা করা হয়। স্থানীয়দের অভিযোগ, নিজ ওয়ার্ডের মাদক প্রতিরোধ কমিটির সভাপতি ইলিয়াস কোবরা ওসি প্রদীপ ও পরিদর্শক লিয়াকতের সঙ্গে আঁতাত করে মানুষকে হয়রানি করেন।
এসব অভিযোগ অস্বীকার করে ইলিয়াস কোবরা তাঁকে একটি স্পর্শকাতর মামলায় ফাঁসানোর অপচেষ্টা চলছে বলে দাবি করেন। গতকাল সন্ধ্যায় মোবাইল ফোনে তিনি কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমি জানতামই না যে মেজর সিনহা নামে কেউ আছে। আমি জীবনে স্বপ্নেও তাকে দেখিনি। কেন জানি না এক সাংবাদিক এমন বড় একটি ঘটনার সঙ্গে আমার নাম জড়িয়ে কাল্পনিক কথা লিখছে। আমি নিজেই মাদকের বিরুদ্ধে কাজ করি। মসজিদ কমিটিতেও আছি। এসব কারণে এলাকার কিছু লোক আমার বিরুদ্ধে আছে।’
প্রশ্নের জবাবে ইলিয়াস কোবরা আরো বলেন, ‘লিয়াকতের সঙ্গে আমার পরিচয় আছে। তার বাহারছড়া তদন্ত কেন্দ্রটির মধ্যেই আমাদের এলাকা। মাঝেমধ্যে বিভিন্ন বিষয়ে কথা হয়। সাবেক মেজরের মৃত্যুর দিনও তার সঙ্গে কথা হয়েছে। আমার নামেই এখানে একটা বাজার আছে। সেখানে কমিটির অফিসে বসে ছিলাম। মোহাম্মদ নামে একজন সদস্য বলেন, একটি বস্তা পাওয়া গেছে। তখন লিয়াকত সাহেবকে ফোন করলে এসে নিয়ে যান। টেকনাফ থানার এসআই হাসান আমাদের সেই সদস্যকে নিয়ে গেছেন। তখন আমি তাকে বললাম, যিনি দেখে জানিয়েছে, তাকেই যদি নিয়ে যান তাহলে খবর দেবে কে? পরে দুবার ফোন দিয়ে ছেড়ে দেওয়ার অনুরোধ করি। তারা ছেলেটিকে ৫৪-এ চালান দেয়। সে গতকাল (শনিবার) জামিনে ছাড়া পেয়েছে।’
স্থানীয়রা বলছে, মিয়ানমারের রাখাইনের আদি নিবাস থেকে বাহারছড়ায় আসার পর বাংলা চলচ্চিত্রে খল অভিনেতা হিসেবে নাম করেন ইলিয়াস কোবরা। বিগত বিএনপি-জামায়াত সরকারের আমলেও টেকনাফ এলাকায় রাজনীতিসহ নানা কাজে দাপুটে ভূমিকা ছিল তাঁর। মাঝে এলাকায় দেখা না গেলেও গত পাঁচ বছর ধরে আবার সক্রিয় হয়ে উঠেছেন। প্রদীপ কুমার টেকনাফ থানার ওসি হিসেবে যোগ দেওয়ার পরই ইলিয়াস কোবরা বাহারছড়া ৯ নম্বর ওয়ার্ডের মাদক নির্মূল কমিটির সভাপতি মনোনীত হন। মেরিন ড্রাইভের পাশে নোয়াখালীপাড়ার পৈতৃক বসতিতে ‘ইলিয়াস কোবরা বাজার’ নামে একটি বাজারও চালু করেন। উপজেলা প্রশাসনের অনুমতি ছাড়া নিজের নামে এ রকম বাজার বসানোর কারণে আদালতে মামলাও চলছে।
অভিযোগ রয়েছে, ইলিয়াস কোবরা মাদক নির্মূল কমিটির সভাপতি হলেও তাঁর পরিবারের অনেক স্বজন ইয়াবা কারবারে জড়িত। এমনকি নিজের ভাই রফিক কোবরা রাজধানী ঢাকা ও টেকনাফ থানার ইয়াবা মামলার আসামি। আরেক ভাই শামশু কোবরার দুই ছেলেও ঢাকা এবং চট্টগ্রামের ইয়াবা মামলার আসামি। তাঁরা সবাই ইয়াবা মামলায় জেলে আটক ছিলেন।
বেরিয়ে এলো আরেক রহস্য : ৩১ জুলাই কথিত বস্তা উদ্ধারের ঘটনা খতিয়ে দেখতে গিয়ে পাওয়া গেছে চাঞ্চল্যকর তথ্য। স্থানীয়রা জানায়, সেই রাতে নোয়াখালীপাড়া সৈকতে একটি ইঞ্জিনচালিত নৌকা থেকে যে বস্তা উদ্ধার করা হয়েছে বলা হচ্ছে, তাতে বিপুল পরিমাণ ‘আইস’ (ইয়াবার মতোই নতুন মাদক) পাওয়া যায় বলে তারা শুনেছে। কোটি কোটি টাকা মূল্যের এই মাদকের চালানের কিছু পরিমাণ সেই রাতে টেকনাফ থানার নিজাম নামের একজন এসআই নিয়ে যান। সেই সঙ্গে মোহাম্মদ হোসেন ওরফে মোহাম্মদ (৪০) নামের এক ব্যক্তিকেও থানায় নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। একেই ধরে নেওয়ার কথা বলেন ইলিয়াস কোবরা। কী উদ্ধার হয়েছিল বস্তায় জানতে চাইলে ইলিয়াস কোবরা বলেন, ‘আচারের মতো প্যাকেট ছিল। সাদা সাদা। কেউ জিনিসগুলো কী বলতে পারেনি।’
‘আইস’ নামের নতুন মাদকের চালানটি বহনকারী নৌকার মালিক হচ্ছেন মোহাম্মদ। তিনি কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘১০ কার্টন মাল টেকনাফ থানার কর্মকর্তা নেজাম নিয়ে গেলেও সেই মাল কোথায় তার হদিস নেই। ভাগ্যিস আমাকে আইস নিয়ে চালান দেওয়া হয়নি।’ তিনি আরো বলেন, তাঁর নৌকা নিয়ে জেলেরা সাগরে মাছ ধরার সময় জোয়ারের পানিতে ভেসে আসা এসব মাদকের কার্টন উদ্ধার করে তাঁর নৌকায় তুলে দেন। বাহারছড়া ইউনিয়নের ৯ নম্বর ওয়ার্ড যুবলীগ সভাপতি আবদুল্লাহ কালের কণ্ঠকে বলেন ‘কোটি কোটি টাকা মূল্যের আইস উদ্ধার হলেও মোহাম্মদকে সেই মামলায় আটক করা হয়নি। তা ছাড়া উদ্ধার করা আইস নিয়ে কোনো মামলাও দেখানো হয়নি আজ পর্যন্ত।’