নিউজ ডেস্ক: কাজী এনায়েত উল্লাহ। জন্ম ৮ নভেম্বর ১৯৫৮ সালে বনানী, ঢাকায়। পড়াশোনা করেছেন প্যারিসের সরবোন ইউনিভার্সিটিতে। ছাত্রজীবনে লেখালেখির নানা বিষয় তার মাথায় উঁকি দিত, কিন্তু সাহিত্যচর্চাটা তখন না করতে পারলেও এখন তিনি মনোনিবেশ করেছেন পুরোদমে। তার ভাষায়, ‘জীবনই আমার লেখালেখির অনুপ্রেরণা’। দীর্ঘ প্রবাসজীবনের নানা ঘটনাই তার উপন্যাসের উপজীব্য।
ভালোবাসার রূপান্তর উপন্যাসটি তার রচিত দ্বিতীয় গ্রন্থ। টনি মরিসনের ভাষায়, প্রবাসীদের কোনো ঘর থাকে না। কিন্তু কাজী এনায়েত উল্লাহর উপন্যাসের পরতে পরতে মনে হবে একজন প্রবাসীর ঘর না থাকলেও হৃদয় থাকে। সেই হৃদয়ে ঘোর থাকে, অসীম অকৃত্রিম প্রেমের ঘোর; যা কারও পাসপোর্ট কিংবা করতলের খন্ডিত ভাগ্যরেখায় লেখা থাকে না।
ভালোবাসার রূপান্তর উপন্যাসটি পড়তে পড়তে কেবলই মনে হয়েছে, রাহাত আহমেদ যাকে জ্যোৎস্না কুড়ানো শিখিয়েছিলেন, সে-ও তাঁকে গোলাপ চুরির কৌশল শিখিয়েছিল কোনো এক পূর্ণিমা রাতের বেলে জোছনায়। কিন্তু সেই প্রেম এখন আয়ুপাখি হয়ে কুহু কুহু ডাকে জীবন-নদীর ধারে।
বাস্তবতার বেড়াজাল কারও কারও জীবনে এমনই যে, মাঝে মাঝে ফুলেরাই খেয়ে ফেলে মালীর জীবন। অনেক চড়াই-উৎরাই পার করে রাহাত আহমেদ যখন বুঝতে শিখেছেন মন যেখানে মোমের আলোয় ধ্যানমগ্ন, শরীর সেখানে উপাসনালয়। ততদিনে পদ্মা-মেঘনা-যমুনার জলের ধারা বয়ে গেছে প্যারিসের স্যেন নদীর জলে। বইয়ের নামায়নের দিকে তাকালে সম্পর্কের মেটামরফোসিসের কথা মাথায় আসে, যা পাঠপ্রতিক্রিয়ায়ও অটুট থাকে।
কাজী এনায়েত উল্লাহ তার উপন্যাসে জীবনের গল্পটাকে বলতে চেয়েছেন নিজের মতো করে, খুব সহজে। জীবনের ব্যথাভার প্রকাশে কোনো সাহিত্যতত্ত। কিংবা উপমার ধার ধারেননি। আর তাতেই পাঠক খুঁজে পাবেন বহুমাত্রিক চিন্তার ভাঁজ, বৈচিত্র্যময় স্বাদ কিংবা জীবনের নানা ঘাত-প্রতিঘাত। এখানেই লেখক অনন্য হয়ে উঠেছেন।
নিতম্ব ঘেঁষে দাঁড়িয়ে থাকা তরুণীও যেমন একটা সময় বাস থেকে নেমে যায় অচিন স্টপে, জীবন থেকে তেমন অনেক কিছুই নেমে গেছে, চলে গেছে। মায়ের পুরোনো ট্রাংকে পাওয়া চিঠি পড়ে কোনো এক তরুণী এসে যদি আপনাকে বলে, আপনিই সেই মধুচোর? তাহলে কেমন লাগবে? উপন্যাসের আখ্যান নির্মিত হয়েছে মূলত চারজন ভিন্ন বয়সী নর-নারীর আন্তঃব্যক্তিক সম্পর্কের গল্প নিয়ে; যে গল্প খুব একটা সচরাচর দেখা যায় না। প্রাগৈতিহাসিক কালের ইতিহাসে হয়ত কখনো কখনো খুঁজে পাওয়া যায়। তবে এমন ঘটনা যে আমাদের চারপাশে ঘটছে না, তা বলা যাবে না। কারণ আমরা যা-কিছু জানি না, তা যে নেই তা তো নয়।
বরং এমন অনেক কিছুই আছে। সেটা যেমন বস্তু জগতের ক্ষেত্রে সত্য, তেমনি নর-নারীর সম্পর্কের ক্ষেত্রেও সত্য। জীবন যখন চলে গেছে কুড়ি বছরের ও পারে, তখন যদি হারানো প্রেমিকার উত্তরাধিকারের সঙ্গে দেখা হয়ে যায়, তাহলে কেমন হয়? আর সেই দেখাটা যদি অন্য রকম কোনো দেখা হয়, তাহলে? অস্তিত্বকে ভালোবেসে কতজনই তো করে সন্ধ্যামালতীর চাষ। শাহানাও মেঘ ধরবে বলে আকাশে পাতে মায়াজাল।
অন্যদিকে সন্ধ্যার একটু কাঁচামিঠে অন্ধকারের জন্য কতশত বিকেল প্রতীক্ষা করেছে ফারহানা রহমান ফিনা। সেই সব প্রতীক্ষা প্রার্থনার মতো। মধুপুরের বনমাঝে ছিমছাম বাগানবাড়িতে কাটানো রঙিন সময়গুলো ছিল রাহাত আহমেদ ও শাহানার জন্য বাস্তবের মাঝে স্বপ্নিল সুতা কাটা ঘুড়ি। কোমল কোমরের ভাঁজে ভাঁজে জমে থাকা থই থই সুখকান্নারাশি। রাতভর জাগিয়ে রাখে বিনাসুতিপ্রেম। শুনেছি, সন্দেহরা মরে গিয়ে ঝিঁঝি পোকা হয়ে ডাকে। প্রেমাত্মাগুলো মরে গেলে হয়ে যায় সাদা খরগোশ।
কিন্তু কেউ কি জানে, সম্পর্ক পুরোনো হলে কিংবা মনের মানুষ হারিয়ে গেলে কী হয়? কিংবা খুঁজে পেলে কী হতে পারে? অনেক বছর পরে হারিয়ে যাওয়া প্রেমিক কিংবা প্রেমিকার সন্তানের সাথে সম্পর্কের টানাপোড়েনটা কেমন হয়? কাজী এনায়েত উল্লাহ ফ্রান্সপ্রবাসী একজন লেখক। তিনি শুধু বাংলাদেশের ভৌগোলিক সীমানাই অতিক্রম করেননি, তিনি আমাদের সামাজিক রীতিনীতি, মূল্যবোধের সীমানাকেও অতিক্রম করার প্রয়াস পেয়েছেন তাঁর উপন্যাসে।
নর-নারীর সম্পর্কের পৌনঃপুনিকতা, মিথস্ক্রিয়ায় সামাজিক যেসব নীতি-নৈতিকতা কিংবা অনৈতিকতার সীমারেখা বাধা হয়ে দাঁড়ায়, তা কি সব সময় মানতেই হবে? কে কবে মেনেছে? প্রেম কি ওসবের ধার ধারে? না, একদমই না। বরং মনকদমের রেণু ছুঁয়ে ছুঁয়ে তারা নেমে যায় অবগাহনে। কিন্তু সেই প্রেম যারা পেয়েও হারায়, পূর্ণদৈর্ঘ্য মহাকাব্যের পুরোটাই লেখা থাকে তাদের করোটিতে। আমি আশাবাদী, ভালোবাসার রূপান্তর উপন্যাসটি পড়ে পাঠক ভিন্নমাত্রিক এক আস্বাদ অনুভব করবেন।
বেলে জোছনা দেখতে দেখতে হারিয়ে যাবেন রূপান্তরিত ভালোবাসার অতল গহরে। উপন্যাস ভালোবাসার রূপান্তর লিখেছেন কাজী এনায়েত উল্লাহ। বইটির প্রচ্ছদে হিমেল হক, প্রকাশনা করেছেন প্রথমা প্রকাশন। ৮৮ পৃষ্ঠার বইটির মূল্য ধরা হয়েছে ২৫০ টাকা।