নিউজ ডেস্ক: সরকার-বিরোধী বিক্ষোভের আগুনে পুড়ছে রাজধানী তেহরান-সহ ইরানের অন্তত ৮০টি শহর। মানবাধিকার এবং মৌলিক অধিকার ফিরে পাওয়ার দাবিতে বিক্ষোভ দেখাতে শুরু করেছেন সে দেশের বহু মানুষ। মাত্র কয়েক দিনের ব্যবধানে রণক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে ইরান। নেপথ্যে ইরানের ২২ বছরের এক তরুণী মাহশা আমিনির মৃত্যু।
পশ্চিম ইরানের কুর্দিস্তান প্রদেশের সাক্কেজ শহরের পড়তে গিয়েছিলেন মাহশা। ১৩ সেপ্টেম্বর বৃহস্পতিবার কুর্দিস্তান থেকে রাজধানী তেহরানে আসছিলেন তিনি। তেহরানে পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে মাহশা দেখা করতে যাচ্ছিলেন। সঙ্গে ছিলেন ভাই কিয়ারেশ আমিনিও।
কিয়ারেশ এবং মাহশা হাইওয়ে দিয়ে যাওয়ার সময় তেহরানের কিছু আগে তাদের পথ আটকায় টহলে থাকা পুলিশের দল। কিয়ারেশ-মাহশাকে গাড়ির কাচ নামানোর নির্দেশ দেওয়া হয়।
পুলিশের নজরে পড়েন গাড়ির ভিতরে হিজাব না পরে বসে থাকা মাহশা। যেখানে দেশের সর্বোচ্চ নেতা বাড়ির বাইরে গেলে মহিলাদের হিজাব পরার নির্দেশ দিয়েছেন, সেখানে এই তরুণী কী ভাবে হিজাব না পরে বেরিয়েছেন? গর্জে ওঠে পুলিশের দল। শুরু হয় আইনরক্ষকের ‘নীতিপুলিশি’।
স্থানীয় সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদন অনুযায়ী, গাড়ির ভিতরে বসে থাকা ভাই-বোনের উপর হম্বিতম্বি শুরু করে দেয় পুলিশ। মাহশা হিজাব কেন পরেননি? বার বার করা হয় একই প্রশ্ন। মাহশার ‘দোষ’, তিনি প্রশ্নের জবাবে ব্যক্তি স্বাধীনতার কথা বলেছিলেন। জানিয়েছিলেন তার ইচ্ছার কথা।
প্রত্যক্ষদর্শীদের বিবরণ অনুযায়ী, এর পরই রেগে আগুন হয় ওই পুলিশের দল। হিজাব না পরার ‘শাস্তি’ হিসাবে গাড়ি থেকে হিড়হিড় করে টেনে নামানো হয় মাহশাকে। মাটিতে লুটিয়ে পড়লেও তাকে টেনে হিঁচড়ে পুলিশের গাড়িতে তোলে পুলিশ।
ভাই কিয়ারেশকে পুলিশ জানায়, মাহশাকে ‘সহবৎ’ শেখাতে কিছু সময়ের জন্য আটকে রাখা হবে। কিছু ক্ষণ পরই তাকে ছেড়ে দেওয়া হবে।
ছাড়া পেয়েছিলেন মাহশা। তবে ছাড়া পেয়ে বাড়ি যাওয়ার পরিবর্তে হাসপাতালে ভর্তি করাতে হয় তাকে। হাসপাতালে তিন দিন কোমায় থাকার পর গত ১৬ সেপ্টেম্বর তিনি মারা যান।
হাসপাতালের চিকিৎসকরা জানান, ‘ব্রেন ডেড’ অবস্থায় হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়েছিল মাহশাকে। হৃদ্স্পন্দন থাকলেও নড়াচড়ার ক্ষমতা ছিল না। তাঁকে আইসিইউতে ভর্তি করানো হয়। এর ৪৮ ঘণ্টা পর মাহশা হৃদ্রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান। অনেক চেষ্টা করেও বাঁচানো যায়নি তাকে।
প্রত্যক্ষদর্শীদের দাবি, পুলিশের গাড়িতে তুলতে তুলতে এবং গাড়িতে উঠিয়ে মাহশাকে বেধড়ক মারধর করে পুলিশ। আর সেই কারণেই তিনি কোমায় চলে যান বলেও অনেকের দাবি।
মাহশার খবর চাউর হতেই ইরানে দিকে দিকে অসন্তোষের আগুন ছড়িয়ে পড়ে। গত সপ্তাহের শেষে ইরানের উত্তরে কুর্দিস্তানে প্রথম প্রতিবাদ শুরু হয়, যা ক্রমে ছড়িয়ে পড়ে গোটা দেশে। আজ ৯ম দিনে পড়েছে সেই বিক্ষোভ।
মাহশার মৃত্যুর পর থেকেই ইরানের রাস্তায় দেখা যাচ্ছে গণক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ। হিজাব পোড়ানো থেকে শুরু করে মাথার চুল কেটে ফেলা- বিভিন্ন অভিনব পন্থায় প্রতিবাদে নেমেছেন সে দেশের বহু পুরুষ-নারী।
বিক্ষোভ সামাল দিতে সরকারের তরফ থেকে রাস্তায় পুলিশ নামিয়েও বিশেষ লাভ হয়নি। পুলিশকে লক্ষ্য করে চলেছে ইট-পাথরের বৃষ্টি। পোড়ানো হয়েছে পুলিশের গাড়িও। গুলি চালিয়েও সাধারণ মানুষকে ‘বাগে’ আনতে পারছে না পুলিশ। প্রতিদিন সন্ধ্যা নামার পরই তেহরানের বিভিন্ন এলাকায় জড়ো হচ্ছেন বিক্ষোভকারীরা।
পুলিশের পাল্টা গুলিতে ইতিমধ্যেই মারা গেছে ৫০ জনেরও বেশি মানুষ। তবে সরকারি হিসেবে নিহতের সংখ্যা ৩৫।
বিবিসিকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে মৃত মাহশার বাবা আমজাদ আমিনি দাবি করেন, কোনও রকম অসুস্থতা ছিল না মাহশা আমিনির। প্রশাসন তার মৃত্যু নিয়ে মিথ্যে কথা বলছে।
মাহশার বাবা বলেছেন, ‘আমার মেয়ের কোনও রকম অসুস্থতা ছিল না। কয়েক বার ঠাণ্ডা লাগা ছাড়া ওকে কখনও হাসপাতালে নিয়ে যেতে হয়নি। ঘটনার দিন আমার সতেরো বছরের ছেলে মাহশার সঙ্গে ছিল। ছেলের বার বার অনুরোধ সত্ত্বেও মেয়েকে পুলিশ মারধর করে। মেয়েকে আটক করার পরে আমাকে এক বারও ওর সঙ্গে দেখা করতে দেওয়া হয়নি। শুধু মৃত্যুর পরে কবরের জন্য মুড়ে রাখা শরীরটা আমরা দেখেছি। মাথা আর মুখটুকু খোলা ছিল। ওর পায়ের তলায় ক্ষতের দাগ ছিল’।
আমজাদের অভিযোগ, হাসপাতালে চিকিৎসকেরাও মেয়েকে দেখতে দেননি। যিনি ময়না তদন্তের রিপোর্ট লিখছিলেন, সেই চিকিৎসক আমজাদকে বলেন, ‘আমার যা ইচ্ছে তা-ই রিপোর্টে লিখব। তুমি কিছু করে উঠতে পারবে না’। মৃতদেহের পায়ে ক্ষত চিহ্ন দেখে তা নিয়ে পরীক্ষার আর্জি জানিয়েছিলেন আমজাদ। মেয়ে-হারানো বাবার ক্ষোভ, ‘বিষয়টি নিয়ে পুলিশ-প্রশাসন তদন্তের প্রতিশ্রুতি দিলেও কিছুই করেনি। ওরা এত দিন আমায় পাত্তা দেয়নি। এখন মিথ্যে বলছে’। চোখের জল মুছতে মুছতে বাবা বলেন, ‘গত কাল ওর জন্মদিন ছিল। মাইক্রোবায়োলজি নিয়ে পড়তে চেয়েছিল। ডাক্তার হতে চেয়েছিল। ওর কোনও স্বপ্ন আর সত্যি হবে না’।