নিউজ ডেস্ক: জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব থেকে মানুষকে বাঁচাতে বন ধ্বংস বা উজাড় বন্ধ করে বনাঞ্চলের পরিধি বাড়াতে অঙ্গীকার করেছেন বিশ্ব নেতারা। স্কটল্যান্ডের গ্লাসগোতে অনুষ্ঠিত ২৬তম বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলনের (কপ-২৬) তৃতীয় দিনে গতকাল মঙ্গলবার শতাধিক দেশ বন রক্ষায় একটি চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছে। এটিই কপ ২৬-এর প্রথম বড় চুক্তি। এতে পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলের বন রক্ষার জন্য সরকারি ও বেসরকারি সূত্র থেকে ১৯০ কোটি ডলারের তহবিল জোগানোরও প্রতিশ্রুতি রয়েছে। জাতিসংঘের পরিবেশ কর্মসূচির একজন ঊর্ধ্বতন উপদেষ্টা চার্লস ম্যাকনিল বিশ্ব নেতাদের এ চুক্তিকে পৃথিবীর জন্য একটি শুভ সূচনা বলে বর্ণনা করেছেন। প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নে স্বাক্ষরকারী দেশগুলোর মধ্যে অন্যতম ব্রাজিল, কানাডা, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, রাশিয়া, চীন, ইন্দোনেশিয়া এবং কঙ্গো। এসব দেশ বিশ্বব্যাপী ৮৫ ভাগ কার্বন নিঃসরণের জন্য দায়ী। তবে বন রক্ষার এ চুক্তিতে নেই বাংলাদেশ ও ভারতের নাম।
এদিন এই দশকের শেষে ৩০ শতাংশ কার্বন নিঃসরণ কমাতে একমত হয়েছে ৮০টিরও বেশি দেশ। যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের (ইইউ) নেতারা বলেছেন, শক্তিশালী গ্রিন হাউস গ্যাস মোকাবিলায় বৈশ্বিক উষ্ণতা ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়ারে মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন তার বক্তব্যে কার্বন নির্গমন হ্রাসের এ ‘গেম-চেঞ্জিং মিথেন প্ল্যান’ প্রতিশ্রুতিতে স্বাক্ষরকারী সবাইকে ধন্যবাদ জানিয়েছেন। তিনি বলেছেন, সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের মধ্যে একটি হলো উষ্ণতার মাত্রা ১.৫ ডিগ্রি বা নাগালের মধ্যে রাখা। কারণ আমরা আজ যে উষ্ণতা অনুভব করছি তার প্রায় অর্ধেক ঘটছে কার্বন নিঃসরণ থেকে।
ইউরোপিয়ান কমিশনের প্রেসিডেন্ট উরসুলা ভন ডার লেইন বলেছেন, কার্বন নিঃসরণ কমানো সবচেয়ে কার্যকর বিষয়ের মধ্যে একটি, যা আমরা করতে পারি। আমরা ২০৫০-এর জন্য অপেক্ষা করতে পারি না। আমাদের দ্রুত নিঃসরণ কমাতে হবে। কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো ২০৩০ সালের মধ্যে তেল ও গ্যাস শিল্প থেকে ৭৫ শতাংশ কার্বন নিঃসরণ কমাতে অঙ্গীকার করেছেন। তিনি বলেন, শিল্পের মধ্যে কার্বন নিঃসরণ কমাতে প্রযুক্তি তাদের আছে। তাই কম খরচে কার্বন নিঃসরণ কমানো সম্ভব।
যদিও জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস বিবিসিকে বলেছেন, বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধি ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসে সীমিত করার চুক্তি সই কপ ২৬-এর জন্য খুব কঠিন হবে। কারণ উন্নত এবং উন্নয়নশীল দেশগুলোর মধ্যে বিশ্বাসের গুরুতর সমস্যা রয়েছে।
এর আগে সম্মেলনে ২০৩০ সালের মধ্যে বন ধ্বংসের প্রক্রিয়া বন্ধ এবং তা প্রতিহত করার অঙ্গীকার কথা জানিয়ে সভার আয়োজনকারী দেশ যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন বলেছেন, আগের চেয়ে বেশি অর্থাৎ মোট ১১০ দেশ এ প্রতিশ্রুতি দিয়েছে।
যেসব দেশ বন রক্ষার এ অঙ্গীকারে স্বাক্ষর করেছে তাদের মধ্যে ব্রাজিলও রয়েছে। দক্ষিণ আমেরিকার এ দেশে আমাজন অরণ্যের একটি বড় অংশের গাছ কেটে ফেলা হয়েছে। বন রক্ষার জন্য ১৯.২ বিলিয়ন ডলারের তহবিল জোগানোর প্রতিশ্রুতি রয়েছে এ চুক্তিতে। জলবায়ু পরিবর্তনে কারণে ক্ষতিগ্রস্ত বিভিন্ন উন্নয়নশীল ও অনুন্নত দেশকে ক্ষতি পুষিয়ে উঠতে এ তহবিল থেকে অর্থ দেওয়া হবে, যাতে ভূমিক্ষয় রোধ, দাবানল নিয়ন্ত্রণ এবং আদিবাসী সম্প্রদায়গুলোর সহযোগিতা করা যায়।
বিশেষজ্ঞরা এ পদক্ষেপকে স্বাগত জানিয়ে সতর্ক করেছেন যে, ২০১৪ সালে করা আরেকটি চুক্তি বন উজাড়কে মোটেও ধীর করতে পারেনি। তাই শুধু চুক্তি করলে হবে না, বাস্তবায়নও করতে হবে। কারণ, গাছ কাটার ফলে জলবায়ুতে বিরূপ প্রভাব পড়ে।
এ চুক্তি যখন হচ্ছে তখনো পরিবেশাবাদী সংগঠনগুলো সম্মেলনস্থলের বাইরে আন্দোলন করছিল। প্ল্যাকার্ড হাতে ধনী দেশগুলোর বিরুদ্ধে তাদের সেøাগান দিতে দেখা যায়। অনলাইন স্ট্রিমিং সাইট নেটফ্লিক্সের শো ‘স্কুইড গেম’-এর থিমযুক্ত একটি প্রতিবাদ সম্মেলনস্থলের কাছে ক্লাইড আর্কে অনুষ্ঠিত হয়। এডিনবার্গে আর্থিক পরিষেবা জায়ান্ট জেপি মরগানের অফিসের বাইরে আরেকটি বিক্ষোভ হয়েছে। তবে এবারের আন্দোলনের কেন্দ্রবিন্দুতে ছিলেন সুইডেনের ১৮ বছরের তরুণী গ্রেটা থানবার্গ। গত রবিবার বিবিসি একটি শোতে ব্রিটিশ সরকারকে চ্যালেঞ্জ করেছেন তিনি। ব্রিটিশ সরকার দাবি করেছে, ১৯৯০ সালের পর ব্রিটেন ৪৪ শতাংশ কার্বণ নিঃসরণ কমিয়েছে। গ্রেটা এ তথ্যকে চ্যালেঞ্জ করে বলেছেন, ৪৪ শতাংশ কমিয়েছে এটা শুনতে ভালো লাগে। তবে প্রকৃত অর্থে ৪৪ শতাংশ কমেনি। রাজনৈতিক নেতাদের অংশগ্রহণের এ সম্মেলনে জলবায়ুর কোনো পরিবর্তন আনতে পারবে না।
গতকাল সকালে গ্লাসগোতে গ্রেটাকে ঘিরে সম্মেলনস্থলে বিশাল জনস্রোত তৈরি হয়। সম্মেলনে বিশ্ব নেতারা আগামী বিশ্ব গড়ার যে কথা বলছেন সেটা ছাপিয়ে গর্জে উঠেছে গ্রেটা তর্জনি উঁচিয়ে বলা কথা- তোমরা রাজনীতিবিদরা ভান করছ।
এদিকে এবারের সম্মেলনে প্রায় ২৮টি দেশ বন উজাড় করে উৎপাদন হওয়া বিভিন্ন কৃষিপণ্য যেমন- পাম অয়েল, সয়া এবং কোকোয়ার উৎপাদন বন্ধের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। এ ছাড়া ৩০টিরও বেশি কোম্পানি বনভূমি ধ্বংস রোধ করতে ১.১ বিলিয়ন পাউন্ড অর্থ দেওয়ার অঙ্গীকার করেছে।
ইউনিভার্সিটি কলেজ লন্ডনের জলবায়ু ও বনবিষয়ক বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক সিমন লিউইস বলেন, এ মুহূর্তে এটি ভালো খবর যে বিভিন্ন দেশের রাজনৈতিক নেতারা বন উজাড় রোধে কাজ করবেন। কিন্তু ২০১৪ সালেও এমন প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল, কিন্তু বাস্তবায়ন হয়নি। তাই সঠিকভাবে অর্থ বরাদ্দ, পরিকল্পনা এবং সবার সমান অংশগ্রহণের মাধ্যমে জলবায়ু পরিবর্তন রোধে এগিয়ে আসতে হবে।
গতকাল সম্মেলনের তৃতীয় দিনে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সম্মেলনকক্ষে দ্বিপাক্ষিক বৈঠক করেছেন। সেখানে তিনি বক্তব্য দিয়েছেন।
ইসরায়েলের মন্ত্রী সম্মেলনে ঢুকতে পারেননি : সোমবার কারিন এলহারার নামের ইসরায়েলের মন্ত্রী জানান, তিনি সম্মেলনে অংশ নিতে পারেননি। কারণ হুইলচেয়ার নিয়ে জলবায়ু সম্মেলনে প্রবেশের কোনো সুযোগ নেই। টুইটারে এলহারার বলেন, এটি খুবই দুঃখের বিষয় যে, জাতিসংঘ তাদের আয়োজিত বিভিন্ন অনুষ্ঠান ও সম্মেলনে (হুইলচেয়ারে করে) প্রবেশের সুযোগ রাখে না।
এ ঘটনায় ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে ইসরায়েল। দেশটির প্রধানমন্ত্রী নাফতালি বেনেটের নেতৃত্বে জলবায়ু সম্মেলনে অংশ নেওয়া প্রতিনিধি দলের এক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, বিষয়টি নিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে আয়োজকদের কাছে অভিযোগ করেছেন তারা।