নিউজ ডেস্ক: বাংলাদেশে সাংবাদিকতার জগতে মানিক মিয়া এক প্রবাদপ্রতিম পুরুষ। তথাকথিত নিরপেক্ষতা, নাকি মানুষের মুক্তির লক্ষ্যে জনসচেতনতা সৃষ্টিই সাংবাদিকতার মূল লক্ষ্য—এই বাস্তবতায় তিনি তথাকথিত নিরপেক্ষতার বদলে মানুষের মুক্তির পক্ষেই নিজেকে, সাংবাদিকতাকে নিয়োজিত করেছিলেন। কোনো মতবাদ প্রচারণা নয়, সাংবাদিকতার একমাত্র ও প্রধান লক্ষ্য যে গণমানুষের মুক্তির জন্য নিয়োজিত থাকা, ন্যায়ের প্রশ্নে অবিচল থাকা—এই কথা তিনি তার সারা জীবনের কাজ দিয়ে প্রমাণ করে গেছেন।
দৈনিক ইত্তেফাক প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে সাংবাদিকতাকে অবলম্বন করে জীবনব্যাপী তিনি এদেশের মানুষের অধিকার আদায়ের সংগ্রামে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছেন। বাংলাদেশে (তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান) তার হাত ধরেই সাংবাদিকতা এক নতুন মোড় নিয়েছিল। পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর শোষণ ও নির্যাতনের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ সৃষ্টির লক্ষ্যে তিনি আমৃত্যু নিরলসভাবে কাজ করে গেছেন। সেজন্য তিনি বাংলার মানুষের কাছে ‘নির্ভীক সাংবাদিক’ হিসেবে পরিচিত হয়ে উঠেছিলেন।
গণমুখী সাংবাদিকতার পথিকৃত্ ব্যক্তিত্ব তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়ার ৫২তম মৃত্যুবার্ষিকী আজ। ১৯৬৯ সালের এই দিনে মাত্র ৫৮ বছর বয়সে পাকিস্তানের রাওয়ালপিন্ডিতে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন ক্ষণজন্মা এই সাংবাদিক। বর্তমান বাংলাদেশে নির্ভীক সাংবাদিকতার প্রেরণা-পুরুষ হিসেবে বিরাজ করছেন তিনি।
ইত্তেফাক ছিল রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগের মুখপত্র—বর্তমান সময়ে এসে এমন কথা বলে ইত্তেফাকের ভূমিকাকে অনেকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে চান। কিন্তু ইত্তেফাক সব সময় মনে করেছে, সাংবাদিকতার মূল লক্ষ্যই হচ্ছে মানুষের কথা বলা, মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠায় ভূমিকা রাখা। ইত্তেফাক পূর্ব পাকিস্তানে যে ভূমিকা পালন করেছিল, তা ছিল সময়ের দাবি। আওয়ামী লীগের সেই সময়ের রাজনীতিকে ইত্তেফাক জনগণের দাবি বলেই মনে করেছিল। তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়ার অবস্থান, ইত্তেফাকের সাংবাদিকতা এবং আওয়ামী লীগ ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অবস্থান ছিল এক ও অভিন্ন। সে কারণে অনেকে সেই অবস্থানের সমালোচনা করেন। কিন্তু ইত্তেফাক তথাকথিত নিরপেক্ষ সাংবাদিকতা করেনি। মানুষের মুক্তির পক্ষে সরাসরি অবস্থান নিয়েছে জাতির প্রতিটি ক্রান্তিকালে। মানিক মিয়া ছিলেন তার কান্ডারি। আজও ইত্তেফাক তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়ার সেই নীতি অবলম্বন করেই প্রকাশিত হচ্ছে।
সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে সোচ্চার থেকে আপসহীনভাবে মানিক মিয়া সত্য প্রকাশ করে গেছেন। একসময় তত্কালীন পাকিস্তান সরকারের সামরিক শাসক ইত্তেফাকের প্রকাশনা বন্ধ করে দেয়। সে সময় সরকারের সঙ্গে আপস করলে তিনি ইত্তেফাক প্রকাশনা অব্যাহত রাখতে পারতেন। কিন্তু তিনি এবং তার চেতনায় উদ্বুদ্ধ সাংবাদিকেরা জনমানুষের সংবাদপত্রের প্রতি যে বিশ্বাস, তার সঙ্গে আপস করেননি। তিন বছর পত্রিকা প্রকাশ বন্ধ রেখেছিলেন। সামরিক জান্তা ও স্বৈরাচারী শাসকের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে নির্ভীক সাংবাদিকতার যে উদাহরণ তিনি সৃষ্টি করে গেছেন, তা পৃথিবীর ইতিহাসে এক বিরল দৃষ্টান্ত।
পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে অর্থনৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক বৈষম্যের কথা সহজ ভাষায় তিনি মানুষের সামনে তুলে ধরেন। তিনি ছিলেন আধুনিক সংবাদপত্রের রূপকার, বাঙালি জাতীয়তাবাদ আন্দোলনের অন্যতম প্রবক্তা। ‘রাজনৈতিক ধোঁকাবজি’, ‘রাজনৈতিক মঞ্চ’ আর ‘রঙ্গমঞ্চ’ শিরোনামে কলাম লিখে বাংলাদেশের মানুষকে স্বাধীনতাকামী করে তোলেন মানিক মিয়া। ‘মোসাফির’ শিরোনামে তার ‘রাজনৈতিক মঞ্চ’ কলামে নির্ভয়ে সত্য উচ্চারণ, অনন্য রাজনৈতিক দিকনির্দেশনা এবং গণমানুষের প্রতি ভালোবাসার কারণেই বাংলার মানুষের হূদয়ে তিনি অবিনশ্বর হয়ে রয়েছেন।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ‘আমার মানিক ভাই’ শিরোনামে এক লেখায় উল্লেখ করেছিলেন, ‘…আমার ব্যক্তিগত জীবনে মানিক ভাইর প্রভাব যে কত গভীর, তা ভাষায় ব্যক্ত করার মত নয়। ১৯৪৩ সাল থেকে তাঁর সাথে আমার পরিচয়। সে পরিচয়ের পর থেকে সারাটা জীবন আমরা দু’ভাই একসাথে জনগণের অধিকার অর্জনের সংগ্রাম করেছি।…একটা বিষয়ে আমরা উভয়ই একমত ছিলাম এবং তা হল, বাংলার স্বাধীনতা। স্বাধীনতা ভিন্ন বাঙালির মুক্তি নেই, এ বিষয়ে আমাদের মাঝে কোন দ্বিধাদ্বন্দ্বের অবকাশ ছিল না। আর ছিল না বলেই নানা ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্যেও দু’জন দু’ফ্রন্টে থেকে কাজ করেছি। আমি কাজ করেছি মাঠে-ময়দানে আর মানিক ভাই তাঁর ক্ষুরধার লেখনীর সাহায্যে।’
আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী এক সাক্ষাত্কারে বলেছেন, ‘আজ যে স্বাধীনতার সোনালি ফসল আমরা ঘরে তুলছি সেজন্য ইত্তেফাক ও মানিক মিয়ার একক অবদান অসাধারণ। বাংলাদেশের স্বাধীনতার ইতিহাসে ইত্তেফাক একটি অবিস্মরণীয় নাম হয়ে থাকবে। আজকের সাংবাদিকতায় বাণিজ্য ও মুনাফা প্রধান লক্ষ্য, কিন্তু সে যুগের সাংবাদিকতায় আদর্শ এবং তার জন্য লড়াই ছিল মুখ্য উদ্দেশ্য। সাংবাদিকদের গাড়ি-বাড়ি ছিল না, কিন্তু ছিল অটুট আদর্শ, নিষ্ঠা। মানিক মিয়া শুধু সংবাদপত্রের মালিক ছিলেন না, ছিলেন জনজীবনভিত্তিক সাংবাদিকতার পথিকৃত্।’
নীতির প্রশ্নে, বাংলার মানুষের অধিকারের বিষয়ে মানিক মিয়া কখনো আপস করেননি। দৈনিক ইত্তেফাক ছিল তার সেই সংগ্রামী জীবনের প্রধান হাতিয়ার। দৈনিক ইত্তেফাকের প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক, প্রবাদপ্রতিম এই ব্যক্তিত্ব দেশের সাংবাদিকতাকে একটানে বদলে দিয়েছিলেন। মানুষের প্রত্যাশা, বেদনাকে জোরালোভাবে তুলে ধরার এক আশ্চর্য ক্ষমতা ছিল তার। শুধু সাংবাদিক কিংবা রাজনীতির প্রথপ্রদর্শকই নন, মানুষ হিসেবেও তিনি ছিলেন আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্বের অধিকারী। তার সংস্পর্শে যিনি একবার এসেছেন, তিনি তার সম্মোহনী ব্যক্তিত্বের প্রতি আকৃষ্ট হয়েছেন। তেমনি তার সহানুভূতিশীল হূদয় ও মানুষের প্রতি মমত্ববোধ আজও মানুষের মুখে মুখে উচ্চারিত হয়। তিনি যেমন বাংলা সাংবাদিকতা জগতে পথপ্রদর্শক, তেমনি রাজনীতিতেও। রাজনৈতিক জগতে তিনি ছিলেন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর ভাবশিষ্য। ঘনিষ্ঠ ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে গভীর সম্পর্ক ছিল মানিক মিয়ার।
তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া ছিলেন উদার গণতন্ত্রের ধারক। একজন রাজনীতিমনস্ক সাংবাদিক হয়েও তার রাজনৈতিক কোনো উচ্চাভিলাষ ছিল না, ছিল না ব্যক্তিগত কোনো লোভ। এ কারণেই সত্ ও নির্মোহ অবস্থান থেকে সত্য কথা বলার সাহস দেখাতে পারতেন। জেল-জুলুম, অত্যাচার, নিপীড়ন এবং সরকারের অসহযোগিতাকে মোকাবিলা করে, নীতির প্রশ্নে অবিচল থেকে তিনি মানুষের অধিকারের কথা বলে গেছেন।
মানিক মিয়ার সংক্ষিপ্ত জীবনী
তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়ার জন্ম ১৯১১ সালে পিরোজপুর জেলার ভাণ্ডারিয়া গ্রামে। তার বাবার নাম মুসলেম উদ্দিন মিয়া। শৈশবেই মানিক মিয়ার মা মারা যান। গ্রামের পূর্ব ভাণ্ডারিয়া মডেল প্রাইমারি স্কুলে মানিক মিয়ার শিক্ষাজীবনের শুরু। তারপর ভাণ্ডারিয়া হাইস্কুল হয়ে চলে যান পিরোজপুর জেলা সরকারি হাইস্কুলে। সেখান থেকেই তিনি কৃতিত্বের সঙ্গে ম্যাট্রিক পাশ করেন। ১৯৩৫ সালে মানিক মিয়া ডিস্টিংশনসহ বরিশাল বিএম কলেজ থেকে বিএ ডিগ্রি লাভ করেন। পড়াশোনা শেষ করে তিনি পিরোজপুর জেলা সিভিল কোর্টে চাকরি শুরু করেন। ১৯৩৭ সালে ফরিদপুর জেলার ভাঙ্গা থানার অন্তর্গত গোয়ালদী গ্রামের অভিজাত পরিবারের খোন্দকার আবুল হাসান সাহেবের কন্যা মাজেদা বেগমের সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন তিনি।
দৈনিক ইত্তেফাক আইয়ুব খানের সামরিক শাসনবিরোধী আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। সামরিক আইন লঙ্ঘনের অভিযোগে ১৯৫৯ সালে তিনি এক বছর জেল খাটেন। ১৯৬৬ সালে তিনি আবার গ্রেফতার হন। এ সময় দৈনিক ইত্তেফাকের প্রকাশনা নিষিদ্ধ এবং নিউ নেশন প্রিন্টিং প্রেস বাজেয়াপ্ত করা হয়। এর ফলে তার প্রতিষ্ঠিত অন্য দুটি পত্রিকা ঢাকা টাইমস ও পূর্বাণীও বন্ধ হয়ে যায়। গণ-আন্দোলনের মুখে সরকার ইত্তেফাকের ওপর বিধিনিষেধ প্রত্যাহার করতে বাধ্য হয়। ফলে ১৯৬৯ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি পত্রিকাটি আবার প্রকাশিত হয়।
মৃত্যুবার্ষিকীর কর্মসূচি
দৈনিক ইত্তেফাকের প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়ার ৫২তম মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষ্যে আজ মঙ্গলবার সকাল থেকে মরহুমের আজিমপুর কবরস্থানের মাজারে কোরআনখানি এবং সকাল ১০টায় মোনাজাতের আয়োজন করা হয়েছে। মরহুমের কনিষ্ঠ পুত্র আনোয়ার হোসেন মঞ্জু এমপির পক্ষ থেকে এতিমখানায় কোরআনখানি ও দোয়া মাহফিলের আয়োজন করা হয়েছে। মানিক মিয়ার জ্যেষ্ঠ কন্যা আখতারুন্নাহার বেবীর পরিবারবর্গের পক্ষ থেকে বাদ জোহর নিজ বাসভবনে কোরআনখানি ও দোয়া অনুষ্ঠিত হবে।
এদিকে স্বাধীন সংবাদপত্র পাঠক সমিতি জাতীয় প্রেসক্লাবের তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া মিলনায়তনে বেলা ১১টায় ‘মহান স্বাধীনতাসংগ্রামে তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া ও দৈনিক ইত্তেফাকের ভূমিকা’ শীর্ষক আলোচনাসভা ও দোয়া মাহফিলের আয়োজন করেছে। এতে প্রধান অতিথি থাকবেন তথ্য ও সম্প্রচারমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ। সভাপতিত্ব করবেন স্বাধীন সংবাদপত্র পাঠক সমিতির কেন্দ্রীয় সভাপতি এস এম জামাল উদ্দিন।