নিউজ ডেস্ক: আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) কাছ থেকে সাড়ে ৪ বিলিয়ন বা ৪৫০ কোটি ডলার ঋণ নিতে প্রাথমিক সমঝোতায় পৌঁছেছে বাংলাদেশ। ফলে দেশের অর্থনীতির বেশির ভাগ সূচকে যে নিম্নমুখী প্রবণতা দেখা দিয়েছে, তা সামাল দেয়া সরকারের জন্য সহজ হবে। সংকট কেটে যাবে। এখন প্রয়োজন আইএমএফ’র পরামর্শগুলো যথাযথভাবে বাস্তবায়ন করা ও ঋণ সঠিকভাবে ব্যবহার করা।
আইএমএফ’র ঋণের বিষয়ে প্রতিক্রিয়ায় পিআরআই নির্বাহী পরিচালক ও দীর্ঘদিন আইএমএফ’র গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব পালন করে আসা আহসান এইচ মনসুর বলেন, করোনা মহামারির ধাক্কার পর রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে দেশের অর্থনীতিতে যে সংকট সৃষ্টি হয়েছে, তা সামাল দেয়া সরকারের জন্য সহজ হবে। কঠিন পরিস্থিতিতে আইএমএফ’র ঋণটা খুব দরকার ছিল। এই ঋণ একটি আস্থার সৃষ্টি করবে। এখন বিশ্বব্যাংক যে দেড় বিলিয়ন ডলার ঋণ দিতে চাচ্ছে, সেটা দ্রুত ছাড় করবে। এডিবি এগিয়ে আসবে। জাইকাসহ সবাই এগিয়ে আসবে। বাংলাদেশ মোটামুটি স্বস্তির মধ্যে থাকবে।
সরকারের কাজ হবে আইএমএফ ঠিক যে কারণে ঋণটা দিচ্ছে, সেটার যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিত করা। তিনি বলেন, অনেক কিছু যাচাই-বাছাই করেই কিন্তু আইএমএফ ঋণ দিতে রাজি হয়েছে। তারা অতীত ইতিহাস ঘেঁটে দেখেছে, বাংলাদেশ বিদেশি যেকোনো ঋণ পরিশোধের ক্ষেত্রে ভালো ভাবমূর্তি বজায় রেখেছে। কখনো কোনো ঋণ শোধের ক্ষেত্রে খেলাপি হয়নি। তিনি বলেন, বেশ কয়েকদিন ধরে আলোচনা হচ্ছে, ঋণের জন্য অনেক শর্ত দিয়েছে আইএমএফ। আসলে আইএমএফ যেসব শর্তের কথা বলেছে, সেগুলো একটাও নতুন নয়। আইএমএফ অনেকদিন ধরেই এগুলো বলে আসছে। তবে এগুলো শর্ত নয় পরামর্শ বলে মনে করেন তিনি। যেমন; আইএমএফ আমাদের রাজস্ব আদায় বাড়াতে বলেছে, ট্যাক্স-জিডিপি অনুপাত বাড়াতে বলেছে, খেলাপি ঋণ কমাতে বলেছে, বাংলাদেশ ব্যাংককে স্বায়ত্তশাসন দিতে বলেছে-এগুলো আমরাও আগে থেকেই বলে আসছি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ও অর্থনীতিবিদ সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, আইএমএফ’র আলোচিত এই ঋণ দেশের অর্থনীতির জন্য মঙ্গল হবে। নতুন ঋণ পাওয়ার রাস্তা খুলে যাবে। তবে আত্মতুষ্টিতে ভোগা যাবে না। এতে আমাদের অর্থনীতির ক্ষতি হয়ে যাবে। বরং সংকট মোকাবিলায় আরও পদক্ষেপ নিতে হবে। কারণ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মতো আমরাও সংকটের মধ্যদিয়ে যাচ্ছি। তাই প্রতিটি সিদ্ধান্ত দেখেশুনে, দেশের স্বার্থে নিতে হবে। তিনি বলেন, এই ঋণের ভালো প্রভাব আছে। আমাদের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ চাপে ছিল। তাছাড়া এই ঋণের সঙ্গে কিছু রিফর্মস (সংস্কার) আসবে। আমরা অর্থনীতিবিদরা যেসব সংস্কারের কথা এতদিন বলে আসছিলাম। এসব সংস্কার বাংলাদেশের জন্য দরকার ছিল। সেই রিফর্মসগুলো এখন হবে। এ ছাড়া কৃষি খাতে ভর্তুকি কমানোসহ আরও কিছু রিফর্মস আইএমএফ চাচ্ছে, সেগুলো না করলেও চলবে। সাবেক এই গভর্নর বলেন, আইএমএফ অনেক শর্ত দিয়েছে। কিন্তু সব শর্ত বাংলাদেশের পক্ষে বাস্তবায়ন করা সম্ভব হবে না। দেখতে হবে আমাদের আর্থসামাজিক অবস্থা। সেটার ভিত্তিতে আমরা তাদের শর্ত পালন করবো।
সিপিডি নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন বলেন, গত এক বছর ধরে বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে টান পড়েছে এবং ক্রমান্বয়ে তা নিচের দিকে যাচ্ছে। ফলে বাংলাদেশকে রিজার্ভ স্বস্তিকর অবস্থায় রাখার জন্য শর্তসাপেক্ষে আইএমএফ’র কাছ থেকে ঋণ নিতে হচ্ছে। তিনি বলেন, বাংলাদেশ বা যেকোনো স্বল্পোন্নত বা উন্নয়নশীল দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা, সুশাসন ভালো থাকে, তা নয়। তাই তাদের ঋণে শর্ত থাকে। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ভিত্তিকে আরও শক্তিশালী করতে সংস্কার কার্যক্রম একটা চলমান বিষয় হওয়া উচিত ছিল। কিন্তু দুঃখজনক হলো- আমরা স্বপ্রণোদিত হয়ে সেগুলো করতে পারিনি। এর আগে আমাদের যেসব প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার হয়েছে, সেগুলো দাতা সংস্থাগুলোর ঋণের শর্তের কারণে হয়েছে। তাহলে আমরা কেন দাতা সংস্থার অপেক্ষায় থাকবো? তাদের টাকা নেবো, তার বিনিময়ে সংস্কার করবো- এট তো শোভনীয় নয়। তিনি বলেন, আমরা যদি টেকসই ও অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়ন করতে চাই, তাহলে প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার এবং সুশাসন নিশ্চিত করার কাজ আমাদের নিজেদেরকেই করতে হবে।
উল্লেখ্য, মোট ৭ কিস্তিতে ঋণ দেবে আইএমএফ। প্রথম কিস্তির টাকা ছাড় হবে আগামী বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে। এর পরিমাণ ৪৪৮ মিলিয়ন বা ৪৪ কোটি ৮০ লাখ ডলার। ঋণের পরবর্তী কিস্তিগুলো ৬ মাস পর পর পাবে বাংলাদেশ সরকার। আইএমএফ’র ঋণের সুদ হার ২.২ শতাংশ। আইএমএফ’র সঙ্গে ঋণ কর্মসূচির ক্ষেত্রে প্রধান ৫টি বিষয়ে সংস্কারে সম্মত হয়েছে সরকার। এগুলো হলো- বাড়তি আর্থিক সংস্থানের জায়গা তৈরি করা, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ ও মুদ্রানীতি কাঠামোর আধুনিকায়ন, আর্থিক খাত শক্তিশালীকরণ, প্রবৃদ্ধির সম্ভাবনা ত্বরান্বিত করা এবং জলবায়ু সহনশীলতা গড়ে তোলা।