নিউজ ডেস্ক: যুদ্ধে ভয়াবহ নৃশংসতার চিত্র দেখলেই কবীর সুমনের গানের দু’টি লাইন খুব মনে পড়ে-‘যুদ্ধটাকে চিতায় তোলো, যুদ্ধটাকেই কবর দাও’। শুধু ইউক্রেন ও রাশিয়ার যুদ্ধ নয়; ফিলিস্তিন, ইয়েমেন, সিরিয়া, ইরাক ও আফগানিস্তানের প্রতিদিনের চিত্র এই আকুতির জন্ম দেয়। তবে জানি এই আকুতি হৃদয়ছোয়া হলেও বিশ্বের বর্তমান প্রেক্ষাপটে তা একেবারেই অবাস্তব।
যুদ্ধের আগুন ইউরোপকে ছাড়েনি
ইউরোপ ও আমেরিকার কারসাজিতে ফিলিস্তিন, আফগানিস্তান, ইরাক, সিরিয়া ও ইয়েমেনে লাখ লাখ মানুষের প্রাণহানি ঘটেছে। এসব দেশকে কার্যত ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছে। মুসলিম দেশগুলোতে যুদ্ধের আগুন জিইয়ে রাখতে দশকের পর দশক ধরে ‘সর্প হইয়া দংশনের পর ওঝা হইয়া ঝাড়ার’ ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে পশ্চিমারা। সন্ত্রাসী গোষ্ঠী আইএস প্রতিষ্ঠার পেছনে আমেরিকা তথা পশ্চিমাদের ভূমিকার কথা মার্কিন শীর্ষ নেতারাও বহু বার স্বীকার করেছেন। আবার তারাই সেই আইএস দমনের অজুহাতে মুসলিম দেশগুলোতে সেনা মোতায়েন করে লুটপাট চালিয়েছেন। আজকের যুদ্ধাক্রান্ত ইউরোপীয় দেশ ইউক্রেনও একই বাহানায় আফগানিস্তান ও ইরাকে সেনা পাঠিয়ে মার্কিন নেতৃত্বাধীন আগ্রাসনে শামিল হয়েছে। এভাবে আধিপত্য ও অস্ত্র ব্যবসা অটুট রাখার পাশাপাশি নিজেদের ভূখণ্ড যুদ্ধমুক্ত রাখতে চেয়েছে তারা। মুসলিম বিশ্বকে অশান্তি ও অনৈক্যের মধ্যে ডুবিয়ে রাখাকে নিজেদের দেশে শান্তি ও সৌহার্দ্য নিশ্চিত করার মন্ত্র বানিয়েছে ইউরোপ ও আমেরিকা। কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি। প্রায় ৮০ বছর পর আবারও যুদ্ধ ইউরোপে গেছে। এই যুদ্ধের পেছনেও উসকানি রয়েছে ইউরোপের সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ মিত্র আমেরিকার।
আগ্রাসন ও বর্ণবাদের পক্ষে ইউক্রেনের অবস্থান
ইউক্রেনের বর্তমান প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি ২০২১ সালে গাজায় ইসরাইলি আগ্রাসনের সময় ফিলিস্তিনিদের বিরুদ্ধে অবস্থান নেন। তিনি এক টুইট বার্তায় আগ্রাসী শক্তিকেই ভিকটিম হিসেবে ঘোষণা করেন। মজলুমের আত্মরক্ষার অধিকারকে অস্বীকার করে বর্ণবাদী জালিমের পক্ষে অবস্থান নেন। যদিও ফিলিস্তিনিদেরকে তাদের ভিটেমাটি থেকে তাড়িয়ে ইসরাইল নামক এই অবৈধ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ইতিহাস জেলেনস্কির অজানা নয়। ফিলিস্তিনিদের বিরুদ্ধে কথা বলার সময় জেলেনস্কি ভাবতেও পারেননি যুদ্ধ তার কাছেও যাবে। ইউক্রেন যুদ্ধে ইউরোপের বর্ণবাদী চরিত্রও আরেক দফা প্রকাশ পেয়েছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রকাশিত বেশ কিছু ভিডিওতে দেখা গেছে, পোল্যান্ডে প্রবেশের ক্ষেত্রে সাদা চামড়ার মানুষদের অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে। ত্বক সাদা রঙের না হলেই লাইনের পেছনে ঠেলে দেওয়া হয়েছে। আফ্রিকান ও এশিয়ান অভিবাসীদের সঙ্গে দুর্ব্যবহারের অসংখ্য অভিযোগ পাওয়া গেছে। কয়েক জন আফ্রিকান অভিবাসী সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভিডিও পোস্ট করে জানিয়েছেন, রাশিয়া বোমা হামলা শুরু করার পর তাদেরকে ইউক্রেন থেকে পালাতে ট্রেনে উঠতে বাধা দেওয়া হয়েছে। ব্রাইসন নামের একটি টুইটার অ্যাকাউন্টে পোস্ট করা এক ভিডিওতে দেখা যায়, একজন কৃষ্ণাঙ্গ নারী ইউক্রেনের একটি ট্রেন স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে উঠার চেষ্টা করলে প্রবেশপথে ইউনিফর্ম পরা পুরুষরা তাকে বাধা দেন। কিন্তু এর কয়েক মিনিট পরই একজন শ্বেতাঙ্গ মহিলাকে ট্রেনে উঠতে দেওয়া হয়।
ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ অনুমেয় ছিল
জাতিসংঘে অনুমোদিত মিনস্ক চুক্তি লঙ্ঘন করে ইউক্রেন যেভাবে সমর শক্তি বাড়াচ্ছিল তাতে রাশিয়ার রোষানলে পড়ার বিষয়টি অনেকটা অনুমেয়ই ছিল। ২০১৪ ও ২০১৫ সালে স্বাক্ষরিত মিনস্ক চুক্তিতে পূর্ব ইউক্রেন থেকে সামরিক স্থাপনা, ভারী সামরিক সরঞ্জাম ও বিদেশি সেনাদের সরিয়ে নেয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল কিয়েভ। ২০১৪ সালের মিনস্ক চুক্তি কার্যত ভেস্তে যাওয়ার পর হুমকির সুরে ইউক্রেনে অস্ত্র পাঠানোর প্রস্তাব দেয় আমেরিকা। মার্কিন প্রশাসন যে ইউক্রেনকে যুদ্ধক্ষেত্র বানাতে চাচ্ছিল সে ইঙ্গিত তখনি পাওয়া যায়। সে সময় জার্মানি ও ফ্রান্সের প্রচেষ্টায় মিনস্ক-টু চুক্তি সই হয়। রুশ ভাষাভাষী অঞ্চল দোনবাসে শান্তি প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে ইউক্রেনে সহিংসতা নিরসনই ছিল মিনস্ক চুক্তির উদ্দেশ্য। কিন্তু জো বাইডেন ক্ষমতা গ্রহণের পর মার্কিন প্রশাসনের উসকানিতে ইউক্রেনে পশ্চিমাদের অস্ত্র সরবরাহ বেড়ে যায়। ইউক্রেন সরকার দোনবাসের সঙ্গে যুক্ত এলাকাগুলোতে সামরিক সরঞ্জাম ও সেনা মোতায়েন জোরদার করে। এ অবস্থায় শক্তিধর রাশিয়া উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ে এবং গত বছরের ডিসেম্বরের মাঝামাঝি সময়ে যুক্তরাষ্ট্র ও ন্যাটোর কাছে খসড়া একটি নিরাপত্তা চুক্তি উত্থাপন করে। এর মাধ্যমে রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন তার দেশের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ন্যাটোর প্রতি আহ্বান জানান। পূর্ব ইউরোপে ন্যাটোর সম্প্রসারণের পরিণতির ভয়াবহতা আবারও সামনে আনেন। কিন্তু আমেরিকা ও ন্যাটো মস্কোর উদ্বেগকে গুরুত্ব দেয়নি। রাশিয়ার মতো বড় সামরিক শক্তি ইউক্রেনে পশ্চিমাদের তৎপরতাকে হুমকি ও অবজ্ঞা হিসেবে গণ্য করে হামলার পথ বেছে নেয়। রুশ হামলা শুরুর কয়েক দিন আগেও একবার ইউক্রেন মিনস্ক চুক্তি কার্যকরের প্রতিশ্রুতি দিয়ে পরের দিনই তা থেকে সরে আসে। মিনস্ক চুক্তির একটি পক্ষ দোনবাস। কিন্তু ইউক্রেন জানিয়ে দেয় তারা দোনবাসের সঙ্গে সরাসরি আলোচনা করবে না। ফাঁকা প্রতিশ্রুতি ও সাহস যুগিয়ে আমেরিকা তথা ন্যাটোই জেলেনস্কিকে অলীক ভাবনার পথে ঠেলে দিয়েছে। রাশিয়া-ইউক্রেন সংঘাত যে গোটা ইউরোপের জন্যই ভয়াবহ পরিণতি ডেকে আনতে পারে তা মার্কিন প্রশাসনের অজানা নয়। আসলে আমেরিকাই চেয়েছে যুদ্ধ ইউরোপে যাক। এর মাধ্যমে রাশিয়া ও ইউরোপ উভয়কে দুর্বল করতে চায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। মোড়লিপনা ও অস্ত্র ব্যবসা অটুট রাখতে এর চেয়ে সহজ উপায় আর আমেরিকার সামনে ছিল না।
বিশ্বযুদ্ধের আশঙ্কা এখনও বিদ্যমান
রাশিয়া-ইউক্রেন সংঘাত বিশ্বযুদ্ধে রূপ নিলে বিস্মিত হওয়ার কিছু থাকবে না। রাশিয়া এখনও গোটা ইউরোপ ও আমেরিকার বিরুদ্ধেই যুদ্ধ করছে। এসব দেশ তাদের আধুনিক সমরাস্ত্র প্রকাশ্যেই ইউক্রেনকে দিচ্ছে। আমেরিকা ও ইউরোপের অস্ত্র দিয়ে লড়াই করছে ইউক্রেনের জনগণ ও সেনাবাহিনী। এর বেশিরভাগ অস্ত্র ঢুকছে পোল্যান্ড হয়ে। অস্ত্র সবররাহ রুট বন্ধ করতে রুশ বাহিনী পোল্যান্ডের ওপর আঘাত হানলেই যুদ্ধটা ইউক্রেনের মধ্যে আর সীমাবদ্ধ থাকবে না। পোল্যান্ড ন্যাটোর সদস্য দেশ হওয়ায় যুদ্ধে এই সামরিক জোটও জড়িয়ে পড়তে পারে। যুদ্ধটা এবার বড় পরিসরে শুরু হলে আমেরিকাও তা থেকে রেহাই পাবে না। কারণ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর আমেরিকা ও রাশিয়াসহ কয়েকটি দেশ আন্তমহাদেশীয় অস্ত্রের অধিকারী হয়েছে। এসব দেশের বেশিরভাগই রাশিয়ার মিত্র। প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় আন্তমহাদেশীয় ক্ষেপণাস্ত্র না থাকায় মার্কিন ভূখণ্ডে আঘাত হানা ছিল অত্যন্ত দুরূহ কাজ। এখন সেই কাজটি অনেক সহজ হয়ে গেছে। বোতাম টিপলেই মার্কিন ভূখণ্ডে পৌঁছে যাবে আন্তমহাদেশীয় ক্ষেপণাস্ত্রের ঝাঁক। তবে সংঘাতটা ইউরোপের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করবে আমেরিকাই। দুই পক্ষের ক্ষতিটা আরও বাড়ার পর যুদ্ধ বন্ধে সক্রিয় হয়ে উঠবে ওয়াশিংটন। এর ফলে লাভের কড়িটা আমেরিকার ঘরেই উঠবে। আমেরিকার অস্ত্রবাণিজ্য আরও বেশি জমজমাট হবে। ইউক্রেনকে অস্ত্রের যোগান দেওয়ার কারণে ইউরোপের অস্ত্রভাণ্ডার খালি হচ্ছে। এই ভাণ্ডার পূরণ করার দায়িত্ব পাবে আমেরিকা। একইসঙ্গে অস্ত্রবাণিজ্যের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী রাশিয়াকেও নিজ অস্ত্রভাণ্ডার পূরণ করতে ব্যস্ত রাখা যাবে। রাশিয়ার ঘনিষ্ঠ হওয়ার কারণে আমেরিকার বাণিজ্যিক প্রতিদ্বন্দ্বী চীনও কিছুটা দুর্বল হবে।
আমেরিকার অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক উত্তেজনা ও করোনা মহামারির কারণে গত কয়েক বছর ধরেই আমেরিকা ভাবমূর্তি সংকটে পড়েছে। সেখানে করোনা মহামারিতে বিশ্বের সবচেয়ে বেশি মানুষের প্রাণহানি ঘটেছে। ১০ লাখের বেশি মার্কিন নাগরিক এই ভাইরাসের সংক্রমণে মৃত্যুবরণ করেছেন। এখনও প্রতিদিন সবচেয়ে বেশি মৃত্যু হচ্ছে আমেরিকাতে। চীন করোনা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে পারলেও পারেনি আমেরিকা। মার্কিন নেতৃবৃন্দের জন্য এই পরিস্থিতি সুখকর নয়। ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের ডামাডোলে আমেরিকার এই ব্যর্থতাও কিছুটা ঢাকা পড়বে নিঃসন্দেহে। তবে যুদ্ধের আগুন নিয়ে যেভাবে খেলে যাচ্ছে তাতে আজ হোক আর কাল হোক ইউরোপের মতো আমেরিকাকেও তা স্পর্শ করবে। পার্সটুডে
ড. সোহেল আহম্মেদ: লেখক ও সাংবাদিক