1. ph.jayed@gmail.com : akothadesk42 :
  2. admin@amaderkatha24.com : kamader42 :
বৃহস্পতিবার, ২৬ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৯:০৭ অপরাহ্ন

ভাষাসৈনিক আব্দুল জব্বার ও তাঁর কর্মময় জীবন

আমাদের কথা ডেস্ক
  • আপডেট : রবিবার, ২৫ ফেব্রুয়ারী, ২০২৪

নিজস্ব প্রতিবেদক: ঐতিহাসিক ভাষার মাসে আমরা শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করছি মাতৃভাষা বাংলার জন্য আমাদের অধিকার প্রতিষ্ঠায় অনন্য সংগ্রামী ও আত্মত্যাগে মহিমান্বিত ভাষাসৈনিক রফিক, শফিক, সালাম, জব্বার, বরকত, শফিউরসহ সব ভাষা শহীদকে- যারা বাংলা ভাষার মর্যাদা ও মাতৃভাষার অধিকার প্রতিষ্ঠায় জীবন উৎসর্গ করেছেন।

১৯৯৯ সালে দুজন প্রবাসী বাংলাদেশির উদ্যোগ এবং মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সক্রিয় সমর্থনে মাতৃভাষা ও সংস্কৃতি সুরক্ষা, সংরক্ষণ এবং প্রচারের লক্ষ্যে ইউনেস্কো আমাদের ‘শহীদ দিবস’ ২১ ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। গভীর শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করি, সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে যার অবিসংবাদিত নেতৃত্বে আমরা স্বাধীন বাংলাদেশ অর্জন করেছি। তিনি ভাষা আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে সম্পৃক্ত থেকে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন। বঙ্গবন্ধু ১৯৪৮ সালে ‘রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ’ গঠনের প্রস্তাবক ছিলেন- যা ভাষা আন্দোলনের সূচনা করেছিল। ভাষা আন্দোলনের সময় তিনি বারবার গ্রেপ্তার হয়েছেন। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারিতে ভাষা সংগ্রামীদের হত্যার ঘটনায় বঙ্গবন্ধু তীব্র প্রতিবাদ করেছিলেন। স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধু বাংলাকে আমাদের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি ১৯৭৪ সালের ২৫শে সেপ্টেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের ২৯তম অধিবেশনে প্রথমবারের মতো বাংলায় বক্তৃতা দিয়ে বিশ্ব সম্প্রদায়ের কাছে বাংলা ভাষাকে তুলে ধরেন।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্নেহধন্য ভাষাসৈনিক আব্দুল জব্বার ছিলেন একজন বীর ছাত্রনেতা। ভাষার প্রতি তার অবদান অমূল্য। তিনি ছাত্র অবস্থাতে বঙ্গবন্ধুর সান্নিধ্যে এসে তার আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে ছাত্র রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত হন।

 

আব্দুল জব্বার ’৬২-র শিক্ষা আন্দোলন ও ’৬৬-এর ঐতিহাসিক ৬-দফা আন্দোলন, ’৬৮-র আগরতলা যড়যন্ত্র মামলা, ’৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান, ’৭০-এর নির্বাচন, এবং ’৯০-র স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলন-সংগ্রামে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখেন।

ভাষাসৈনিক আব্দুল জব্বার ১৯৬২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারিতে প্রভাতফেরি, প্ল্যাকার্ড প্রদর্শন ও শোভাযাত্রা করার কারণে গ্রেপ্তার হন ও কারারুদ্ধ ছিলেন। ২১ ফেব্রুয়ারি উদযাপনের জন্য মাসব্যাপী ছাত্রলীগের কর্মীদের নিয়ে পাড়া-মহল্লা ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সভা-সমাবেশ, শিক্ষার্থীদের সংঘটিত ও উদ্বুদ্ধ করেন। তিনি নিজ বাড়িতে ছাত্রলীগের কর্মীদের নিয়ে রাতভর হাতে লেখা পোস্টার ও প্ল্যাকার্ড তৈরি করেন। তার ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় ১৯৬৪ সালে কুলাউড়া শহরে প্রথম শহীদ মিনার নির্মিত হয়।

 

বাংলাদেশ কৃষক লীগের প্রাক্তন সভাপতি আব্দুল জব্বার ১৯৬২-৬৪ সালে ছাত্রলীগের সংগঠক ছিলেন। ১৯৬৪ সালে তিনি কুলাউড়া থানার আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। দেশ স্বাধীন হলে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু কর্তৃক তিনি রিলিফ কমিটির চেয়ারম্যান নিযুক্ত হন। তিনি বাংলাদেশ কৃষক লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সিনিয়র সহ-সভাপতি ও পরে সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। এছাড়া তিনি বঙ্গবন্ধু পরিষদ ও মুক্তিযোদ্ধা সংহতি পরিষদ কেন্দ্রীয় কমিটির প্রতিষ্ঠাতা সহ-সভাপতি, রেডক্রিসেন্ট সোসাইটির সহ-সভাপতি ও ঘাতক-দালাল নির্মূল কমিটির আহ্বায়ক ছিলেন।

 

১৯৭১ সালে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ডাকে সাড়া দিয়ে মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৭ই মার্চের ভাষণের পর স্বাধীনতার পক্ষে জনমত গঠন করতে সংগ্রাম কমিটি গঠন করেন। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কর্তৃক ওয়ারলেসে প্রেরিত স্বাধীনতার ঘোষণা পত্রটি পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ শুরু করেন। তিনি বাংলাদেশ লিবারেশন ফোর্স বা মুজিব বাহিনীর ৪ নং সেক্টরের অধীনস্থ মৌলভীবাজার সেক্টরের ডেপুটি কমান্ডার হিসেবে অসামান্য সাহসিকতার সঙ্গে যুদ্ধ পরিচালনা, মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ প্রদান করেন, এছাড়া কুলাউড়া জংশন স্টেশনের মালবাহী ওয়াগন ভেঙে মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে খাদ্য ও রসদ সামগ্রী সরবরাহ এবং ভারত থেকে অস্ত্র সংগ্রহের ক্ষেত্রে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করার কারণে তার সব সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা হয়েছিল।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে নির্মমভাবে হত্যার পর আব্দুল জব্বার ১৭ আগস্ট কুলাউড়া শহরে প্রতিবাদ সভা, বিক্ষোভ মিছিল ও গায়েবানা জানাজার আয়োজন করেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে তাকে গ্রেপ্তার হতে হয় এবং বঙ্গবন্ধুর অন্যতম খুনি মেজর নূর রাতভর তাকে অমানুষিক নির্যাতন করে, ভোরে ব্রাশ ফায়ার করে হত্যার জন্য উদ্ধত হলে মহান আল্লাহর অশেষ রহমতে তৎকালীন সেনা অফিসার জনাব আমিন আহমেদ চৌধুরী তাকে উদ্ধার করেন এবং তিনি প্রাণে বেঁচে যান। জেল থেকে মুক্তি পেয়ে পুনরায় বঙ্গবন্ধু হত্যা ও জাতীয় চার নেতা হত্যার প্রতিবাদ-প্রতিরোধ ও রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড শুরু করলে আবারও গ্রেপ্তার হন এবং কারাবরণ ও নির্যাতনের শিকার হন।

 

১৯৮৩ সালে বাকশাল গঠন করে আব্দুল জব্বারকে যোগদানের আমন্ত্রণ জানালে সদ্য সাবেক তরুণ পার্লামেন্টারিয়ান আব্দুল জব্বার তা ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করেন এবং বাকশাল যাতে সুসংগঠিত হতে না পারে সেদিকে জোরালো ভূমিকা রাখেন।
বঙ্গবন্ধুর স্নেহধন্য আব্দুল জব্বার ১৯৭৯ সালে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের মনোনীত প্রার্থী হিসেবে নৌকা প্রতীক নিয়ে জাতীয় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। জাতীয় সংসদ সদস্য থাকাকালীন সময়ে তার প্রচেষ্টায় রাজনগর-কুলাউড়া-জুড়ী-বড়লেখা-বিয়ানীবাজার-শেওলা-চারখাই আঞ্চলিক মহাসড়ক (আর-২৮১)-এর রাজনগর-কুলাউড়া-জুড়ী পর্যন্ত রাস্তা পাকাকরণ করা হয়।
অভিজ্ঞ পার্লামেন্টারিয়ান আব্দুল জব্বার বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক জীবনের অধিকারী ছিলেন। মহান মুক্তিযুদ্ধে গৌরবোজ্জ্বল অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ ২০২০ সালে তাকে মরণোত্তর একুশে পদকে ভূষিত করা হয়। তিনি গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা, আইনের শাসন, মানবাধিকার সমুন্নত রাখা, রাজনৈতিক নেতা-কর্মীদের নির্যাতন-নিপীড়নের বিরুদ্ধে জীবন বাজি রেখে প্রতিবাদে সোচ্চার থেকেছেন সব সময়। তার ব্যক্তিত্ব, প্রজ্ঞা, সততা ও দেশপ্রেম সবাইকে অনুপ্রাণিত করে।

 

নন্দিত জননেতা আব্দুল জব্বার তার নির্বাচনী এলাকায় স্কুল-কলেজ, মসজিদ-মাদ্রাসা, মন্দির, রাস্তা-ব্রিজ-কালভার্ট, বিদ্যুৎ-সংযোগ প্রদান, ফায়ার সার্ভিস কেন্দ্র স্থাপন, গরিব ছাত্র-ছাত্রীদের লেখাপড়ায় সাহায্য, দরিদ্র কৃষক, ক্ষুদ্র-নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠী, চা-শ্রমিক, জেলে সম্প্রদায় ও উন্নয়নমূলক কাজের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে সম্পৃক্ত ছিলেন। তিনি একজন শিক্ষানুরাগী, সমাজসেবী ও ক্রীড়া সংগঠক। বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ধারণ করে রাজনীতি ও মানব সেবা এবং এলাকার উন্নয়নই তার একমাত্র ব্রত।

আব্দুল জব্বার ১৯৯২ সালের ২৮ আগস্ট শুক্রবার শোকের মাসে মাত্র ৪৭ বছর বয়সে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন।
বাংলার ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস অটুট রাখতে আব্দুল জব্বারের মতো এমন অবিসংবাদিত নেতার আত্মজীবনী তরুণ প্রজন্মের কাছে শক্তি ও প্রেরণার উৎস হয়ে থাকবে। পৃথিবীতে এমন কোনো দেশ নেই যারা নিজেদের ভাষার জন্য এতটা আত্মত্যাগ করেছে। ভাষা শহীদদের মহৎ কর্মগুলো যেন যুগান্তরের সম্ভাবনাকে ত্বরান্বিত করে সেটা খেয়াল রাখার দায়িত্ব পরিবার, সমাজ তথা দেশের নেতৃত্বদানকারী রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক দলের।

 

বাঙালির জাতীয় জীবনে একুশে ফেব্রুয়ারি তেমনই একটি তাৎপর্যপূর্ণ দিন যেখানে বাংলা ভাষাকে অবহেলিত করা মানে নিজের জাতিগত অস্তিত্বকে অস্বীকার করা। বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষার স্মৃতি-চিহ্নিত এই দিনটি জ্বলন্ত অগ্নিশিখায় উজ্জ্বল এবং রক্তাক্ত আত্মত্যাগের মহিমায় ভাস্বর হয়ে থাকুক যুগে যুগে।

ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলের কলেজে বাংলা ভীতি দূর হোক প্রতিদিন একুশের চেতনাকে ধারণ করে। চাকরির ক্ষেত্রেও অগ্রাধিকার দেওয়া হোক বাংলা সাহিত্য ও ইতিহাসকে যেমনটি ইংরেজি সাহিত্যকে দেওয়া হয়। লেখকরা তথা তরুণ প্রজন্ম বেশি বেশি অনুবাদ সাহিত্যে বাংলা ভাষা নিয়ে কাজের মাধ্যমে বিশ্বের কাছে এর মর্যাদা তুলে ধরুক। বাংলাদেশের সরকারের নিকট আমার এটাই প্রত্যাশা যে, আব্দুল জব্বারের মতো আত্মত্যাগী মহান নেতাদের জীবন ইতিহাস প্রতিনিয়ত তুলে ধরা হোক প্রজন্ম পরম্পরায়। একুশের চেতনায় বাংলা ভাষার মর্যাদা যেন একদিনের উদযাপনের হিড়িকে অন্যদিনে হারিয়ে না যায় সেদিকে দৃষ্টি রাখা হোক।

নিউজটি শেয়ার করুন

এই জাতীয় আরো খবর
© সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত । এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।
Maintained By Macrosys