নিউজ ডেস্ক: কানাডায় পাড়ি জমানোর চেষ্টায় ব্যর্থ হয়ে দেশে ফিরে এসেছেন সমালোচনার মুখে মন্ত্রিত্ব ও দলীয় পদ হারানো ডা. মুরাদ হাসান। গতকাল রবিবার বিকালে এমিরেটস এয়ারলাইন্সের ‘একে-৫৮৬’ ফ্লাইটে ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে নামেন তিনি। দেশে ফেরার আগে মধ্যপ্রাচ্যের একটি দেশেও থাকার চেষ্টা করেছিলেন তিনি। তবে তার সেই চেষ্টাও ব্যর্থ হয়।
এদিকে জিয়া পরিবার নিয়ে অশালীন বক্তব্য দেওয়ার অভিযোগে মুরাদ হাসানের বিরুদ্ধে ঢাকা, চট্টগ্রাম ও বগুড়ায় মামলার আবেদন করা হয়েছে।
গতকাল বিকালে শাহজালাল বিমানবন্দরে দেখা যায়, মুরাদ হাসান প্রথমে বিমানবন্দরের ভিআইপি ফটকের সামনে আসেন। সেখানে সাংবাদিকদের দেখে তিনি আবার ভেতরে চলে যান। এর পর মুরাদ হাসান বিমানবন্দরের ভেতর দিয়ে চলে যান অভ্যন্তরীণ টার্মিনালে। টার্মিনালের বাইরে একটি গাড়ি তার অপেক্ষায় ছিল। পরে ওই গাড়িতে উঠে তড়িঘড়ি করে তিনি বিমানবন্দর ত্যাগ করেন। এ সময় তার পরনে ছিল জিন্সের নীল রঙের প্যান্ট ও জ্যাকেট। মুখে কালো মাস্ক আর চোখে বেশ বড় ফ্রেমের চশমা। তিনি পুরো মুখ ও মাথা ঢেকে নিজেকে আড়াল করেন। কানাডার উদ্দেশে ঢাকা ছাড়ার সময়ও তিনি মুখ ঢেকে রেখেছিলেন। মন্ত্রিত্ব ও দলীয় পদ হারানো ডা. মুরাদ হাসান সপরিবারে থাকতেন রাজধানীর ধানমন্ডিতে। বিমানবন্দর থেকে সরাসরি বাসায় উঠেছেন, নাকি অন্য কোথাও গেছেন, তা জানা যায়নি।
গত বৃহস্পতিবার রাতে কানাডার উদ্দেশে ঢাকা ছাড়েন মুরাদ হাসান। কিন্তু টরন্টোর পিয়ারসন আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর দিয়ে কানাডায় ঢুকতে ব্যর্থ হন তিনি। এর পর দুবাইয়ে প্রবেশের চেষ্টা করেও ব্যর্থ হন। এর পরই দেশে ফিরে আসেন। একের পর এক বিতর্কিত ও
অশালীন বক্তব্য দিয়ে আলোচনা-সমালোচনার কেন্দ্রে আসেন মুরাদ হাসান। একপর্যায়ে টেলিফোনে চিত্রনায়িকা মাহিয়া মাহিকে নিয়ে অশালীন মন্তব্য ও হুমকি দেওয়ার অডিও ফাঁস হওয়ার পর গত মঙ্গলবার তথ্য ও সম্প্রচার প্রতিমন্ত্রীর পদ হারান মুরাদ হাসান। একই দিনে জামালপুর আওয়ামী লীগের পদ থেকেও তাকে সরানো হয়।
এদিকে করোনার ‘ডাবল ডোজ’ টিকার সনদ না থাকায় ডা. মুরাদ হাসান কানাডা ঢুকতে পারেননি বলে জানা গেছে। প্রশ্ন উঠেছে, ভ্যাকসিন সার্টিফিকেট ও কোভিড প্রোটোকল না মেনে মুরাদ কীভাবে ঢাকার বিমানবন্দর থেকে কানাডায় গেলেন? এ বিষয়ে বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী মাহবুব আলী এবং হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের নির্বাহী পরিচালক এএইচএম তৌহিদ-উল আহসানকে গতকাল প্রশ্ন করেন সাংবাদিকরা।
উত্তরে তৌহিদ-উল আহসান বলেন, বিমানবন্দর দিয়ে যে যাত্রীই বাইরের দেশে যান, সেসব বহির্গমন যাত্রীদের স্বাস্থ্য সনদ চেক করা, ভ্যাকসিনেশন সার্টিফিকেট চেক করার দায়িত্ব স্বাস্থ্য বিভাগের। আমরা যাত্রীদের সেবা দিই। ইমিগ্রেশন শাখা ইমিগ্রেশন করবে, স্বাস্থ্যের কাজ স্বাস্থ্য করবে। সন্ধ্যা পৌনে ৬টার দিকে মাহবুব আলী সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বলেন, মুরাদ হাসান কোভিড-১৯ সনদ নিয়েছিলেন কিনা, তার ভিসার মেয়াদ রয়েছে কিনা, এ বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করেছেন ওসি ইমিগ্রেশন ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা।
মুরাদের বিরুদ্ধে মামলার আবেদন : বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের মেয়ে জাইমা রহমান সম্পর্কে কুরুচিপূর্ণ ও অশ্লীল বক্তব্যের অভিযোগে সাবেক তথ্য প্রতিমন্ত্রী ডা. মুরাদ হাসানসহ দুজনের বিরুদ্ধে মামলার আবেদন করেছেন জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরামের নেতা ওমর ফারুক ফারুকী। ঢাকা আইনজীবী সমিতির সাবেক এ সাধারণ সম্পাদক ঢাকার সাইবার ট্রাইব্যুনালে গতকাল এ মামলার আবেদন জমা দেন। মামলার অপর আসামি হলেন মহিউদ্দিন হেলাল নাহিদ। জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরামের নেতা অ্যাডভোকেট মাসুদ আহমেদ তালুকদার জানান, মামলাটি রবিবার দাখিল হলেও বিচারক না থাকায় সোমবার শুনানি হবে।
মামলার আবেদনে বলা হয়, ডা. মুরাদ হাসান সরকারের তথ্য ও সম্প্রচার প্রতিমন্ত্রী ছিলেন এবং ২ নম্বর আসামি নাহিদ একজন মিডিয়া উপস্থাপক। গত ১ ডিসেম্বর আসামি নাহিদ আসামি ডা. মুরাদ হাসানের সাক্ষাৎকার নেন। সাক্ষাৎকারে ডা. মুরাদ হাসান উদ্দেশ্যমূলকভাবে জিয়া পরিবার এবং জাইমা রহমান সম্পর্কে কুরুচিপূর্ণ, মিথ্যাচার, নারী বিদ্বেষী, মানহানিকর অশ্লীল মন্তব্য করেন।
মামলার আবেদনে আরও বলা হয়, আসামি ডা. মুরাদ হাসান সংবিধানের ১৪৮ অনুচ্ছেদের তৃতীয় তফসিল অনুযায়ী যে সাংবিধানিক শপথগ্রহণ করেছিলেন তা এসব কর্মকা-ের মাধ্যমে লঙ্ঘন করেছেন। ওই মিথ্যা ও কুরুচিপূর্ণ মন্তব্য আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটিয়েছে। তাই এ অপরাধ ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ২৫/২৯/৩১/৩৫ ধারায় শস্তিযোগ্য হওয়ায় আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগটি আমলে নিয়ে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করা প্রয়োজন।
এদিকে ডা. মুরাদ হাসান ও ইউটিউবার মহিউদ্দিন হেলাল নাহিদের বিরুদ্ধে চট্টগ্রামের আদালতে মামলার আবেদন হয়েছে। প্রধান আসামির ঠিকানা চট্টগ্রামের বাইরে হওয়ায় আবেদনটি কতটুকু গ্রহণযোগ্য, তার মতামত চাওয়া হয়েছে জেলা ও মহানগর রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীর (পিপি) কাছে। তাদের মতামতের ওপর ভিত্তি করে আগামী ১৫ ডিসেম্বর মামলার গ্রহণযোগ্যতার ওপর শুনানির দিন নির্ধারণ করেছেন আদালত।
গতকাল দুপুরে চট্টগ্রাম বিভাগীয় সাইবার ক্রাইম ট্রাইব্যুনালে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে এ আবেদন করা হয়। ট্রাইব্যুনালের বিচারক জেলা জজ এসকেএম তোফায়েল হাসান মামলাটি আদেশের জন্য রেখে বিকালে এ নির্দেশনা দেন। মামলাটি করেন বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরাম চট্টগ্রাম ইউনিটের সভাপতি ও চট্টগ্রাম জেলা আইনজীবী সমিতির সাবেক সভাপতি অ্যাডভোকেট এএসএম বদরুল আনোয়ার।
এ ছাড়া জাইমা রহমান সম্পর্কে অশ্লীল ও শিষ্টাচারবহির্ভূত বক্তব্য দেওয়ায় সাবেক তথ্য প্রতিমন্ত্রী ডা. মুরাদ হাসানের বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলার আবেদন করা হয়েছে রাজশাহীর সাইবার ট্রাইব্যুনালে। মামলার আবেদন করেন বগুড়া আইনজীবী সমিতির সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও জেলা বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক সাইফুল ইসলাম।
মামলায় ভার্চুয়াল টকশোর উপস্থাপক শেখ মহিউদ্দিন হেলালকেও আসামি করা হয়েছে। সাইফুল ইসলাম বলেন, শেখ মহিউদ্দিন হেলালের ভার্চুয়াল টকশোতে অংশ নিয়ে ডা. মুরাদ হাসান ব্যারিস্টার জাইমা রহমান সম্পর্কে অশ্লীল ও শিষ্টাচারবহির্ভূত বক্তব্য দিয়েছেন। এ কারণে তিনি মামলাটি দায়ের করলেন। আদালত মামলাটি গ্রহণ করলেও কোনো আদেশ দেননি। পরবর্তী সময়ে আদালত এ ব্যাপারে আদেশ দেবেন।
জামালপুরের আওয়ামী লীগ নেতা মতিয়ার রহমান তালুকদারের ছেলে মুরাদ ২০০৮ সালের নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের টিকিটে জামালপুর-৪ (সরিষাবাড়ী) আসনে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। এর পর ২০১৮ সালে তিনি দ্বিতীয়বার সংসদ সদস্য হন। ২০১৯ সালে শেখ হাসিনা তার মন্ত্রিসভায় প্রথমে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব দিয়েছিলেন মুরাদকে। কয়েক মাস পর তাকে সরিয়ে তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রীর দায়িত্ব দেওয়া হয়। সম্প্রতি বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার নাতনিকে নিয়ে বিদ্বেষমূলক মন্তব্য করে সমালোচনায় পড়েন মুরাদ হাসান। এর কয়েক দিনের মধ্যে চিত্রনায়িকা মাহিয়া মাহির সঙ্গে তার অশালীন কথাবার্তার একটি অডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। পাশাপাশি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগ নেত্রীদের নিয়ে মুরাদের অশালীন বক্তব্যের অডিও ভাইরাল হয়। এসব নিয়ে চাপে পড়ে মন্ত্রিত্ব ও দলীয় পদ হারাতে হয় মুরাদকে।