প্যারিসের বিখ্যাত শ্যাঁজ-এলিজে চত্বর রোববার রঙিন সেজেছিল এক অসাধারণ দৃশ্যপটে। বিশ্বের নানা প্রান্তের সংস্কৃতির মিলনস্থল হয়ে উঠেছিল ফরাসি রাজধানী, যেখানে উদযাপিত হলো ‘প্যারিস ট্রপিক্যাল কার্নিভাল ২০২৫’। এ বছরের থিম ছিল: “Amazonies”—বিশ্বের সবথেকে বড় রেইনফরেস্ট আমাজনের জীববৈচিত্র্য ও সংস্কৃতিকে কেন্দ্র করে এক চিত্রময় আয়োজন।
২০০১ সালে শুরু হওয়া এই কার্নিভাল এবার ২৫তম বছরে পা দিল। প্যারিস সিটি কাউন্সিল ও ‘Carnaval Tropical Federation’–এর যৌথ উদ্যোগে আয়োজিত এই উৎসব ফ্রান্সে বসবাসরত ক্যারিবিয়ান, দক্ষিণ আমেরিকান এবং আফ্রিকান অভিবাসী সম্প্রদায়ের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে তুলে ধরার এক গুরুত্বপূর্ণ প্ল্যাটফর্ম হয়ে উঠেছে।
এবারের আয়োজনে অংশ নিয়েছে প্রায় ৪,০০০ নৃত্যশিল্পী ও বাদ্যযন্ত্রী, যারা ১৫টি দেশের প্রতিনিধিত্ব করেন—গুয়াদেলুপ, মার্টিনিক, ফরাসি গয়ানা, হাইতি, ত্রিনিদাদ, ব্রাজিলসহ আরও অনেক।
‘অ্যামাজোনিজ’ থিমের আওতায় এবারের কার্নিভালে তুলে ধরা হয়েছে পরিবেশ রক্ষা, আদিবাসী সংস্কৃতি এবং ব্রাজিলীয় ঐতিহ্যের বিভিন্ন দিক। গায়ে রঙিন পালক ও বর্ণিল মুখোশ পরে শিল্পীরা প্যারেডে অংশ নেন, সাথে বাজে Gwo Ka, Steel Pan, Bèlè ও Afro-Caribbean ড্রাম।
বিশেষভাবে সম্মানিত করা হয়েছে Touloulou চরিত্রটিকে, যেটি ফরাসি গায়ানার ঐতিহ্যের প্রতীক। Touloulou–কে ইউনেস্কোর সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের তালিকায় অন্তর্ভুক্তির প্রচেষ্টা এ বছরকার কার্নিভালের বিশেষ বিষয় হিসেবে বিবেচিত হয়েছে।
কার্নিভালটি দুপুর ১টায় শুরু হয় Place de la Concorde থেকে এবং Avenue des Champs-Élysées ধরে George V পর্যন্ত যায়। এরপর অংশগ্রহণকারীরা ফিরে আসেন Winston Churchill Avenue হয়ে, যেখানে মূল মঞ্চস্থ হয় গ্র্যান্ড ফিনালে।
প্যারিসের ট্র্যাফিক বিভাগ পুরো Champs-Élysées–কে গাড়িমুক্ত ঘোষণা করে, যাতে হাজারো দর্শক নিরাপদে উৎসবে অংশ নিতে পারেন। স্থানীয় প্রশাসনের তথ্য মতে, প্রায় ৫০,০০০ দর্শক এই উৎসব প্রত্যক্ষ করেন, যার মধ্যে পর্যটকের সংখ্যাও ছিল উল্লেখযোগ্য।
এই কার্নিভাল শুধুই বিনোদনের আয়োজন নয়। এর মূল উদ্দেশ্য হলো, সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যকে উদযাপন করা এবং ফরাসি সমাজে অভিবাসী জনগোষ্ঠীর অবদানকে স্বীকৃতি দেওয়া। পরিবেশ সচেতনতা, সাংস্কৃতিক সংরক্ষণ ও সামাজিক সম্প্রীতির বার্তা এ বছর আরও জোরালোভাবে তুলে ধরা হয়েছে।
এ বিষয়ে আয়োজক কমিটির প্রধান, মারি-ক্লোদ মনলুই বলেন: “আমরা শুধু নাচ আর সঙ্গীত নিয়ে আসিনি। আমরা আমাদের ইতিহাস, পরিবেশ ও সমাজের জন্য বার্তা নিয়ে এসেছি। আমাজনের অস্তিত্ব বিপন্ন, আর আমাদের সংস্কৃতিও তাই। একে রক্ষা করা মানে ভবিষ্যত রক্ষা করা।”
কার্নিভালের আগের দিন ৫ জুলাই Grand Palais–এ অনুষ্ঠিত হয় “Grand Bal BrasilBrésil”, যেখানে একসঙ্গে জড়ো হয় হাজারো মানুষ—ব্রাজিলের সাম্বা, ক্যাপোইরা এবং মারাকাতু ছন্দে রাতজুড়ে নাচের মাধ্যমে উৎসবের সূচনা হয়। সাথে ছিল ক্যারিবীয় খাদ্যের স্বাদ–Accras, Colombo, Feijoada, ও Cassava–ভিত্তিক হস্তশিল্পের বাজার।
কার্নিভালের সাফল্যের পেছনে যেমন ছিল ফ্রান্স সরকারের সাংস্কৃতিক দপ্তরের সহযোগিতা, তেমনি গুরুত্বপূর্ণ ছিল অভিবাসী সম্প্রদায়ের ঐক্য। ২০২৫ সালের এই ট্রপিক্যাল কার্নিভাল শুধু এক উৎসব নয়—এটি ছিল সংস্কৃতি, প্রতিবাদ ও পরিচয়ের মিলনমেলা।