নিউজ ডেস্ক: দেশের সাড়ে তিন কোটির বেশি শিশু শরীরে ক্ষতিকর সিসা বয়ে বেড়াচ্ছে। বড়দের তুলনায় শিশুদের শরীরে সিসার বিরূপ প্রভাব বেশি। গতকাল মঙ্গলবার রাজধানীর এক হোটেলে আয়োজিত সেমিনারে এসব তথ্য তুলে ধরা হয়। চলতি বছর জুন থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত করা এক গবেষণার ভিত্তিতে এসব তথ্য পাওয়া যায়।
জাতিসংঘের শিশুবিষয়ক সংস্থা ইউনিসেফের উদ্যোগে সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউট (আইইডিসিআর), আন্তর্জাতিক উদরাময় গবেষণাকেন্দ্র বা আইসিডিডিআরবি সম্প্রতি এই গবেষণা পরিচালনা করে।
গবেষণা প্রতিবেদনের তথ্য তুলে ধরে ইউনিসেফ জানায়, দেশের চারটি জেলার শিশুদের রক্তে সিসার উপস্থিতি পাওয়া গেছে। এর মধ্যে ৬৫ শতাংশের রক্তে সিসার পরিমাণ যুক্তরাষ্ট্রের রোগ নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধ কেন্দ্র (সিডিসি) নির্ধারিত মাত্রার চেয়ে বেশি। ছেলেশিশুর তুলনায় মেয়েশিশুর শরীরে সিসার উপস্থিতি বেশি পাওয়া গেছে।
আইইডিসিআরের গবেষক নওরোজ আফরিন গবেষণার তথ্য তুলে ধরে বলেন, টাঙ্গাইল, খুলনা, সিলেট, পটুয়াখালী—এই চার জেলায় শিশুদের দেহে সিসার মাত্রা পরীক্ষা করা হয়েছে। পরীক্ষিত ৯৮০ শিশুর সবার রক্তে সিসার উপস্থিতি মিলেছে। এর মধ্যে ৬৫ শতাংশ শিশুর রক্তে সিসার মাত্রা যুক্তরাষ্ট্রের সিডিসি নির্ধারিত মাত্রা ৩.৫ মাইক্রোগ্রামের চেয়ে বেশি। এর মধ্যে ২৪ থেকে ৪৮ মাস বয়সী শিশুদের শতভাগের শরীরে সিসার উপস্থিতি পাওয়া গেছে।
আইসিডিডিআরবির করা গবেষণার তথ্য বলছে, ঢাকার ৫০০ শিশুর রক্ত পরীক্ষায় সবার শরীরে সিসার উপস্থিতি পাওয়া গেছে।
সেমিনারে উপস্থিত গবেষকরা বলেন, শৈশবে সিসার প্রভাব বুদ্ধিমত্তা কমায়, মনোযোগের ঘাটতি তৈরি করে এবং শিশুদের লেখাপড়ায় দুর্বল করে তোলে, যা ভবিষ্যতে তাদের অনেক আগ্রাসী করে তোলে।
ইউনিসেফের গবেষণায় জানানো হয়, বাজারের বিভিন্ন পণ্য পরীক্ষা করে ৩৬৭টির মধ্যে ৯৬টিতে সিসার উপস্থিতি পাওয়া গেছে। চারটি শহরে স্থানীয়ভাবে তৈরি খেলনা, রং, অ্যালুমিনিয়ামের হাঁড়ি-পাতিল, সবজি, চাল ও মসলার নমুনায় সিসা শনাক্ত হয়েছে। শহর চারটি হলো ঢাকা, বরিশাল, রাজশাহী ও খুলনা। এ ছাড়া মাটি, ছাই, পোড়া মাটি ও হলুদের গুঁড়ায় সিসার উপস্থিতি দেখা গেছে।
গবেষণার তথ্য বলছে, সিসা দূষিত হলুদের গুঁড়া অন্তঃসত্ত্বা নারীর শরীরে উচ্চ মাত্রার সিসার উপস্থিতির কারণ। পল্লী এলাকায় পরীক্ষা করে ৩০ শতাংশ অন্তঃসত্ত্বা নারীর শরীরে সিসার উপস্থিতি পাওয়া গেছে।
প্রধান অতিথির বক্তব্যে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রী মো. শাহাব উদ্দিন বলেন, ‘সিসা দূষণ থেকে মানুষকে বাঁচাতে সরকার বিভিন্ন উদ্যোগ বাস্তবায়ন করছে। এ লক্ষ্যে পরিবেশ অধিদপ্তর প্রায়ই অবৈধ ব্যাটারি উৎপাদন ও পুনর্ব্যবহারের বিরুদ্ধে আইন প্রয়োগ করছে। শুধু আইন প্রয়োগই কাঙ্ক্ষিত ফল আনতে পারে না, বরং আমাদের ব্যাপক সচেতনতা প্রয়োজন। জনগণের জানা উচিত, সিসা মানবদেহে একটি নীরব ঘাতক এবং প্রায় সমস্ত শরীরের সিস্টেমকে প্রভাবিত করে। সিসার স্নায়বিক বিষাক্ততা ছোট বাচ্চাদের বিকাশমান দেহ এবং মস্তিষ্কের স্থায়ী ও বিধ্বংসী ক্ষতি করে। ’
মন্ত্রী বলেন, সিসা দূষণের ক্ষতিকর প্রভাব সম্পর্কে জনগণকে সচেতন করতে প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়া, সুধীসমাজ ও এনজিওদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে হবে। সরকার প্রথমে ২০০৬ ও ২০২১ সালে এসআরও জারি করে। এসআরওতে সিসা এসিড ব্যাটারির নিরাপদ ব্যবস্থাপনার জন্য পরিবেশগত ছাড়পত্র গ্রহণ, পরিবেশগতভাবে নিরাপদ রিসাইক্লিং, ব্যাটারি ব্রেকার, ডিস্ট্রিবিউটর, ডিলার, আমদানিকারকদের দায়িত্ব ও কর্তব্য, কর্মীদের স্বাস্থ্য সমস্যাগুলো সমাধান করা এবং রিপোর্টিং সিস্টেমের ওপর জোর দেওয়া হয়েছে।
ইউনিসেফের বাংলাদেশ প্রতিনিধি শেলডন ইয়েট বলেন, ‘বাংলাদেশে যে সমস্যা, তার সমাধানও আছে। তবে যত দিন আমরা সমস্যাকে গুরুত্ব দিতে পারব না, তত দিন সমস্যা থাকবে। পরবর্তী প্রজন্মের জন্য এই পরিস্থিতি হুমকিস্বরূপ। এ জন্য সরকারকে এগিয়ে আসতে হবে। ইউনিসেফও এসব বিষয়ে একত্রে কাজ করার আহ্বান জানায়। ’
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক ডা. আমিনুল ইসলামের সভাপতিত্বে সেমিনারে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক এ এইচ এম সফিকুজ্জামান, স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব নিলুফার নাজনীন, আইসিডিডিআরবির নির্বাহী পরিচালক ডা. শামস এল আরেফিন এবং ইউনিসেফ বাংলাদেশের প্রতিনিধি শেলডন ইয়েট বিশেষ অতিথি হিসেবে বক্তব্য দেন। অনুষ্ঠানে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, বিভাগ, এনজিও ও উন্নয়ন সহযোগীদের প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন।