নিউজ ডেস্ক: দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর অবশেষে আগামী জানুয়ারি থেকে ইউরোপের অবাধ চলাচলের কাঙ্খিত শেঙ্গেন জোনে প্রবেশ করবে ক্রোয়েশিয়া৷ বৃহস্পতিবার ইইউর রাষ্ট্রগুলি এই যোগদানের অনুমোদন দিয়েছে৷ তবে শেঙ্গেনে প্রবেশে ইইউ’র অন্য দুই দেশে রোমানিয়া এবং বুলগেরিয়ার আবেদন প্রত্যাখাত হয়েছে৷
২০২৩ সালের ১ জানুয়ারি থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে ২৭তম দেশে হিসেবে ইউরোপের শেঙ্গেন জোনে প্রবেশ করতে যাচ্ছে ক্রোয়েশিয়া৷
অর্থাৎ নতুন বছরের শুরু থেকে ক্রোয়েশিয়ার সাথে ইইউর অন্য দেশগুলোর থাকা স্থল ও সমুদ্র সীমান্তে নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা তুলে নেওয়া হবে৷ তবে বিমানবন্দরগুলোতে আগামী বছরের ২৬শে মার্চ থেকে বিশেষ নজরদারি ব্যবস্থা বাস্তবায়ন করা হবে বলে জানিয়েছে ইইউ কাউন্সিলের বর্তমান সভাপতি দেশ চেক প্রজাতন্ত্র৷
বেলজিয়ামের রাজধানী ব্রাসেলসে ইইউর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীদের বৈঠকে সর্বসম্মতভাবে ক্রোয়েশিয়ার আবেদন অনুমোদিত হয়৷ এই সবুজ সংকেত পাওয়ার ফলে ক্রোয়েশিয়া পৃথিবীর এমন একটি বিশেষ জোনের সদস্য হলো, যেখানে ৪০ কোটিরও বেশি মানুষ কোন প্রকার সীমান্ত নিয়ন্ত্রণ ছাড়াই অবাধে ভ্রমণ করতে পারে৷
৩৯ লাখ জনসংখ্যার দেশ ক্রোয়েশিয়া ২০১৩ সাল থেকে ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্য রাষ্ট্র৷ আগামী জানুয়ারিতে দেশটি ইউরোপের একক মুদ্রা ব্যবস্থা ইউরো জোনেও যোগ দেবে৷
ক্রোয়েশিয়ার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ড্যাভর বোজিনোভিচ টুইটারে দেওয়া এক বার্তায় বলেন , ‘‘শেঙ্গেন জোনে ক্রোয়েশিয়ার অন্তর্ভুক্তি ক্রোয়েশিয়া, ইইউ, অর্থনীতি এবং নাগরিকদের উপকৃত করবে৷’’
অন্যদিকে, ইইউর অপর দুই সদস্য দেশও ক্রোয়েশিয়ার ন্যায় শেঙ্গেনে পরবেশের লক্ষ্য দীর্ঘদিন ধরে চেষ্টা চালিয়ে আসছে৷ কিন্তু ব্রাসেলসের মিটিংয়ে রোমানিয়া এবং বুলগেরিয়ার আবেদন প্রত্যাখান করা হয়েছে৷ রোমানিয়ার প্রার্থীতার আবেদনে অস্ট্রিয়া ভেটো দেয়৷
অপরদিকে, বুলগেরিয়ার আবেদনে বিরোধিতা করে নেদারল্যান্ডস৷
সম্প্রতি তীব্র আশ্রয় আবেদনের মুখোমুখি হওয়া অস্ট্রিয়া কর্তৃপক্ষের আশঙ্কা, এই দুটি দেশে সীমান্ত নিয়ন্ত্রণব্যবস্থা তুলে নেওয়া হলে আরও অভিবাসীদের আগমন ঘটবে৷
শেঙ্গেন জোনের সীমানা বর্ধিতকরণ বা নতুন সদস্য বৃদ্ধির প্রশ্নটি এমন সময়ে আলোচনার টেবিলে এসেছে যখন ইইউএর বহিঃসীমান্তে অনিয়মিত অভিবাসীদের আগমন বাড়ছে৷
হতাশ রোমানিয়া
রোমানিয়ার রাষ্ট্রপতি ক্লাউস ইওহানিস অস্ট্রিয়ার এই সিদ্ধান্তকে ‘দুঃখজনক এবং অন্যায়’ মনোভাব বলে নিন্দা জানিয়েছেন।
তার মতে, এটি ইউরোপীয় ঐক্য এবং সংহতির সাথে আপস করার শামিল৷
অপরদিকে, বুলগেরিয়ার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ইভান ডেমার্ডজিয়েভ অবস্থানে ‘গঠনমূলক ও সুনির্দিষ্ট কোন যুক্তি নেই’ বলে দুঃখ প্রকাশ করেছেন৷
নেদারল্যান্ডসের অভিবাসন বিষয়ক মন্ত্রী এরিক ভ্যান ডার বার্গ দেশটির অবস্থান ব্যাখ্যা করে বলেছেন, ‘‘এই বলকান রাষ্ট্রটির দুর্নীতি এবং মানবাধিকার নিয়ে উদ্বেগ রয়েছে৷’’
আমস্টারডাম ইইউ কমিশনের কাছে এই বিষয়গুলির উপর একটি বিস্তারিত প্রতিবেদন চেয়েছে৷
দীর্ঘ দশ বছর ধরে অপেক্ষা
প্রাক্তন কমিউনিস্ট দেশ রোমানিয়া ও বুলগেরিয়ার শেঙ্গেনে যোগদানের ডসিয়ার দশ বছরে ধরে অপেক্ষমান ছিল৷ দুই দেশ ২০০৭ সালে ইইউতে প্রবেশ করেছিল৷ কিন্তু দীর্ঘ সময় ধরে শেঙ্গেনের দরজায় কড়া নেড়ে এবারো ব্যর্থ হলো তাদের প্রচেষ্টা৷
ইউরোপীয় পার্লামেন্টের প্রেসিডেন্ট রবার্টা মেটসোলা বলেছেন, সোফিয়া এবং বুখারেস্টের আবেদন প্রত্যাখ্যানে তিনি হতাশ৷
স্বরাষ্ট্র বিষয়ক ইইউ কমিশনার ইলভা জোহানসন বলেছেন, ‘‘আজ আমাদের জন্য একটি হতাশার দিন৷ রোমানিয়া ও বুলগেরিয়ার জনগণের শেঙ্গেন জোনের পূর্ণ সুবিধা ভোগ করার অধিকার রয়েছে৷ আমরা অবশ্যই নতুন আরেকটি পদক্ষেপের দিকে এগিয়ে যাব৷’’
ইইউ কমিশন এবং ইউরোপীয় পার্লামেন্ট দীর্ঘদিন ধরে এই তিনটি দেশকে শেঙ্গেনে অন্তর্ভুক্ত করার জন্য সদস্য দেশগুলোর প্রতি আহ্বান জানিয়ে আসছে৷
শেঙ্গেন জোনে ইউরোপীয় ইউনিয়নের বেশিরভাগ দেশ ছাড়াও আইসল্যান্ড, লিচেনস্টাইন, নরওয়ে এবং সুইজারল্যান্ড অন্তর্ভুক্ত রয়েছে৷
ক্রোয়েশিয়া এই জোনে যোগদানের ফলে হাঙ্গেরি এবং স্লোভেনিয়া সীমান্তে যানবাহনের সারি উল্লেখযোগ্যভাবে কমে আসবে এবং এই অঞ্চলের পর্যটন খাত উৎসাহিত হবে৷
তবে এর বিনিময়ে শেঙ্গেনভুক্ত দেশগুলিকে অবশ্যই এই এলাকার বহিঃসীমান্ত কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করার লক্ষ্যে পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে৷ পাশাপাশি সংগঠিত অপরাধ বা সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য সদস্য দেশগুলোর মধ্যে পুলিশি সহযোগিতার প্রতিশ্রুতি দিতে হবে৷
এনজিওগুলোর অভিযোগ
হিউম্যান রাইটস ওয়াচ এবং অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল সহ আটটি মানবাধিকার সংস্থা ক্রোয়েশিয়াকে শেঙ্গেনে পরবেশের সবুজ সংকেতের নিন্দা জানিয়েছে৷
তাদের মতে, ক্রোয়েশিয়া নিয়মিতভাবে শরণার্থী, আশ্রয়প্রার্থী এবং অভিবাসীদের দেশটির ভূখণ্ডে প্রবেশ এবং আশ্রয়ের অধিকারন দিতে অস্বীকার করে৷ এছাড়া ক্রোয়েশিয়ার বিরুদ্ধে অভিবাসীদের সীমান্তে গণহারে জোরপূর্বক পুশব্যাকের অভিযোগ রয়েছে৷
ড্যানিশ রিফিউজি কাউন্সিলের মতে, চলতি বছররে আগস্টের শুরু থেকে নভেম্বরের শেষ পর্যন্ত মোট ১,৩৯৫ জনকে ক্রোয়েশিয়া থেকে বসনিয়া ও হার্জেগোভিনায় অবৈধভাবে পুশব্যাক করা হয়েছে৷
বৃহস্পতিবার প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে ‘বর্ডার ভায়োলেন্স মনিটরিং নেটওয়ার্ক’ জানিয়েছে, ‘‘চলতি বছর গ্রিস ক্রোয়েশিয়া, হাঙ্গেরি, ইটালি সহ পনেরটি ইইউ দেশ এবং পশ্চিম বলকানে অঞ্চলে প্রায় ২৫ হাজার অভিবাসী মারধর, অপমান, নির্বিচারে আটক এবং বেআইলি পুশব্যাকের শিকার হয়েছেন৷’’
এ বিষয়ে এক হাজার ছয়শটিরও বেশি সাক্ষ্য সংগ্রহের তথ্য দিয়েছে এনজিওটি৷