নিউজ ডেস্ক: চীনের ঋণের ফাঁদ নিয়ে প্রচারণা প্রত্যাখ্যান করেছেন ঢাকায় চীনা রাষ্ট্রদূত লি জিমিং। তিনি বলেছেন, বাংলাদেশসহ অন্য দেশের প্রয়োজনে চীন অর্থায়ন করে। চীনের এই অর্থায়ন কোনো বিষ নয়, বরং তা আরোগ্যলাভের উপায়। গতকাল মঙ্গলবার চীনা রাষ্ট্রদূত এক নিবন্ধে এমন মত দিয়েছেন।
ঢাকায় চীন দূতাবাস নিবন্ধটি গণমাধ্যমে পাঠিয়েছে।
রাষ্ট্রদূত লি জিমিং বলেন, “শ্রীলঙ্কা, পাকিস্তান ও নেপালে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক অস্থিরতার খবর স্থানীয় গণমাধ্যমে কয়েক সপ্তাহ ধরে গুরুত্ব পাচ্ছে। বাংলাদেশেও এমনটি হবে কি না তা নিয়ে অনেকেই চিন্তিত। আমাদের অভিজ্ঞতা হলো, ষড়যন্ত্রতত্ত্বের কারণে জনগণের মধ্যে আতঙ্কও নেমে আসে। চীন নিয়ে আতঙ্কিত কিছু গোষ্ঠীর আবারও ‘চীনা ঋণের ফাঁদ’ তত্ত্ব প্রচার দেখে তাই বিস্মিত হইনি। ”
রাষ্ট্রদূত চীনের ঋণ নিয়ে গত মাসে যুক্তরাষ্ট্রের আন্ডারসেক্রেটারি ভিক্টোরিয়া নুল্যান্ড এবং গত ফেব্রুয়ারি মাসে মিউনিখ নিরাপত্তা সম্মেলনে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সুব্রামানিয়াম জয়শঙ্করের বার্তাগুলোর কথা উল্লেখ করেন। স্থানীয় গণমাধ্যমগুলোকে উদ্ধৃত করে রাষ্ট্রদূত লি জিমিং বলেন, দেখা গেছে, উভয় ক্ষেত্রেই বাংলাদেশকে চীন থেকে দূরে সরে আসার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।
চীনা রাষ্ট্রদূত বলেন, নম্রতা এবং অন্তর্ভুক্তিতে সমৃদ্ধ একটি সভ্যতা হিসেবে চীন আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সব স্তরের সমালোচনাকে ততক্ষণ পর্যন্ত স্বাগত জানায়, যতক্ষণ তা যুক্তিযুক্ত এবং অখণ্ডনীয় হয়। চীনের নামে চাপিয়ে দেওয়া ‘ঋণের ফাঁদ’ তত্ত্ব গ্রহণ করার আগে অভিযোগটির সত্যতা পরীক্ষা করা দরকার।
বাংলাদেশের অর্থ মন্ত্রণালয়ের তথ্য-উপাত্ত উল্লেখ করে লি জিমিং বলেন, চীনের ঋণ বাংলাদেশের বৈদেশিক ঋণের মাত্র ৭ শতাংশ। ‘ঋণের ফাঁদ’ স্থাপনের জন্য যদি কাউকে দায়ী করতেই হয়, তাহলে সম্ভবত ঋণদাতা হিসেবে চীনের চেয়ে যারা এগিয়ে তাদের প্রথমে সন্দেহ করা উচিত। ওই তালিকায় প্রথমে আছে বিশ্বব্যাংক, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের মতো অনেক বহুপাক্ষিক ঋণদাতা।
লি জিমিং বলেন, পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন ‘একটি নির্দিষ্ট দেশের’ বিরুদ্ধে ভিক্টোরিয়া নুল্যান্ডের অভিযোগের জবাব দেওয়ার সময় উল্লেখ করেছিলেন, বাংলাদেশ তার প্রকল্পের অর্থায়নের বেশির ভাগই বহুপাক্ষিক আর্থিক প্রতিষ্ঠান এবং জাপান থেকে পায়। নুল্যান্ড স্পষ্টতই ঋণের জন্য জাপানকে চ্যালেঞ্জ করেননি। এর সম্ভাব্য কারণ, জাপান কোয়াডে যুক্তরাষ্ট্রের অন্যতম মিত্র।
চীনা রাষ্ট্রদূত বলেন, চীন বাংলাদেশকে ঋণ দিয়েছে বাংলাদেশের চাহিদা অনুযায়ী। পদ্মা বহুমুখী সেতুর অর্থায়ন নিয়ে বিরোধ কি ভোলা যায়। বিশ্বব্যাংক সরে যাওয়ার পর সেতুর রেল সংযোগে বাংলাদেশ সরকারের বিনিয়োগের পরিপূরক হিসেবে ঠিকাদার ও অর্থ নিয়ে আসে চীন।
রাষ্ট্রদূত বলেন, চীনা প্রস্তাবগুলো সম্মত শর্তের পাশাপাশি প্রতিযোগিতামূলক। চীনা তহবিলের বেশির ভাগই আসে দীর্ঘমেয়াদি এবং সহজ ঋণ হিসেবে। চীনা অর্থায়নে কোনো অযৌক্তিক শর্ত নেই। তবে কিছু পশ্চিমা ঋণদাতার অর্থায়নের প্রস্তাব সব সময় রাজনৈতিক অথবা অর্থনৈতিক সংস্কারের মতো পূর্বশর্ত নিয়ে আসে, যা দেশের সার্বভৌমত্ব ক্ষুণ্ন করে। এমন তিক্ততার স্বাদ বাংলাদেশ পেয়েছে।
নিবন্ধে চীনা রাষ্ট্রদূত বলেন, বিশ্বের বৃহত্তম উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে চীন অন্য দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ না করার নীতিতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। বাংলাদেশের জন্য চীন সব সময় ন্যায্য অর্থায়নের কৌশলগত বিকল্প।
শ্রীলঙ্কার বর্তমান অর্থনৈতিক দুরবস্থার জন্য অনেকে চীনের ‘ঋণের ফাঁদ’কে দায়ী করেন। চীনের রাষ্ট্রদূত বলেছেন, ‘বিদেশি ঋণ শ্রীলঙ্কার অর্থনৈতিক সংকটে ভূমিকা রাখতে পারে। তবে এ ক্ষেত্রে চীনকে বলির পাঁঠা বানানো অযৌক্তিক। ‘
রাষ্ট্রদূত বলেন, শ্রীলঙ্কার অর্থনৈতিক সংকটের কারণ চীন নয়। পরিসংখ্যান অনুযায়ী, শ্রীলঙ্কায় সর্বোচ্চ একক ঋণদাতা এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি)। শ্রীলঙ্কার মোট ঋণের ১০ শতাংশ করে জোগান দিয়েছে জাপান ও চীন। শ্রীলঙ্কার বৈদেশিক ঋণের প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ মার্কিন ডলারে গণনা করা হয়। যুক্তরাষ্ট্র তার ফেডারেল রিজার্ভ ব্যালান্সশিট সংকুচিত করার জন্য প্রস্তুতির ইঙ্গিত দেওয়ায় তা মার্কিন ডলারের বিপরীতে শ্রীলঙ্কার রুপির অবমূল্যায়নকে ত্বরান্বিত করে এবং দেশটির বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ আরো দুর্বল করে।
চীনা রাষ্ট্রদূত বলেন, শ্রীলঙ্কার অর্থনৈতিক অবস্থার ভিত্তিতে অনেক পর্যবেক্ষক বাংলাদেশের সম্ভাবনাকে অস্বীকার করতে চান। এখানে কতগুলো বিষয় আমলে নেওয়া প্রয়োজন। শ্রীলঙ্কা এখন যে পরিস্থিতির মুখোমুখি হচ্ছে তা মূলত ২০১৯ ইস্টার বোমা হামলার পর পর্যটন খাতে ধস থেকে। বিশ্বব্যাপী কভিড-১৯ মহামারি শুরু হওয়ার পর থেকে দেশটির রেমিট্যান্স (প্রবাস আয়) কমে গেছে। আন্তর্জাতিক কারণে খাদ্য ও জ্বালানির ঊর্ধ্বমুখী মূল্য এবং কিছু দেশের একতরফা নিষেধাজ্ঞায় বৈশ্বিক সরবরাহ শৃঙ্খলেরও বড় ক্ষতি হয়েছে। এসবের প্রভাবই শ্রীলঙ্কায় বিদ্যমান।