নিউজ ডেস্ক: ‘শুধুমাত্র দুবেলা ভাতের বিনিময়ে পড়াতে চাই’-এমন শিরোনামের একটি বিজ্ঞাপনের ছবি সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে কদিন ধরে ভাইরাল হয়েছে। বিজ্ঞাপনদাতা মোহাম্মদ আলমগীর কবির তার পেশা হিসেবে বিজ্ঞাপনে উল্লেখ করেছেন ‘বেকার’। বগুড়া শহরের জহুরুল নগরের আশেপাশের এলাকায় প্রথম থেকে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষার্থীদের গণিত ছাড়া সব বিষয় পড়ানোর জন্য ওই বিজ্ঞাপন দেন তিনি।
শহরের বিভিন্ন দেয়ালে, ইলেকট্রিক খুঁটিতে দেখা যাচ্ছে, সাদা এ-ফোর সাইজের কাগজে কালো কালিতে প্রিন্ট করা বিজ্ঞাপনটি। এতে তিনি লিখেছেন, পড়ানোর বিনিময়ে তিনি কোন অর্থ চান না। কেবল সকাল এবং দুপুর এই দুবেলা ভাত খাওয়াতে হবে এই হচ্ছে শর্ত।
বিবিসি বাংলার এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিজ্ঞাপনটি দিয়েছেন মো. আলমগীর কবির নামে এক ব্যক্তি, বিজ্ঞাপনে তার নাম এবং ফোন নম্বর দেওয়া হয়েছে। সেই নম্বরে ফোন করে জানা যাচ্ছে, কবির বগুড়া সরকারি আজিজুল হক কলেজ থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ থেকে অনার্স এবং মাস্টার্স পাস করেছেন।
কেন এমন বিজ্ঞাপন? জানতে চাইলে আলমগীর কবির বলেন,‘মূলত খাবারের কষ্ট থেকেই বিজ্ঞাপন দিয়েছি।’ তিনি বলেছেন, ‘এই মূহুর্তে আমার একটি টিউশনি আছে। সেখানে রাতে পড়াই। তারা আগে নাস্তা দিতো। পরে আমি তাদের বলেছি নাস্তার বদলে ভাত খাওয়াতে।’
কিন্তু রাতে খাবারের সংস্থান হলেও সকাল আর দুপুরে খাবারের ব্যবস্থা ছিল না বলে জানান ওই বিজ্ঞাপনদাতা। তিনি আরও বলেন, ‘আমি টিউশনি করে পাই দেড় হাজার টাকা, সেটা দিয়ে হাত খরচ, খাবার, চাকরির পরীক্ষা দিতে যাওয়া-সব কুলিয়ে উঠতে পারছিলাম না। সেজন্য আমি যেখানে থাকি তার আশেপাশে টিউশনি খুঁজছি যেখানে আমার অন্তত দুবেলা খাবারের ব্যবস্থা হয়ে যায়।’
২০২০ সালে স্নাতকোত্তর পাসের পর থেকে চাকরি খুঁজছেন, কিন্তু এখনো প্রত্যাশামাফিক চাকরি পাননি বলে জানান আলমগীর কবির।
এদিকে, বিজ্ঞাপন ফেসবুকে ভাইরাল হওয়ার পর সান্ত্বনা দিয়ে অনেকে ফোন করেছেন তাকে। কেউ আবার আলমগীরকে তৈরি পোশাক কারখানায় চাকরি করতে ডেকেছেন। কিন্তু পোশাক কারখানায় যেতে চান না তিনি। কারণ চাকরির ইন্টারভিউ থাকলে তারা ছুটি দিতে চায় না বলে জানিয়েছেন জয়পুরহাটের পাঁচবিবির স্থায়ী বাসিন্দা আলমগীর কবির।
এই ঘটনা বাংলাদেশের বেকারত্বের একটি সাম্প্রতিক উদাহরণ। কিন্তু দেশটিতে বেকারত্বের চিত্র আসলে কতটা উদ্বেগজনক? বাংলাদেশে সর্বশেষ শ্রমশক্তি জরিপ হয়েছিল ২০১৬-২০১৭ অর্থবছরে। পরিসংখ্যান ব্যুরোর করা ওই জরিপে দেশের মোট বেকারের সংখ্যা উল্লেখ করা হয়েছিল ২৭ লাখের মতো।
তবে বিশ্লেষকদের অনেকেই মনে করেন, দেশে বেকারের সংখ্যা এখন জরিপের তথ্যের চেয়ে অনেক বেশি। এর মধ্যে ২০২০ সালে করোনাভাইরাস মহামারি শুরু হলে চাকরির বাজারে একটি নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। চাকরিচ্যুতি, বেতন কাটা, কারখানা বন্ধ এমন ঘটনার কথা যেমন শোনা যাচ্ছিল, তেমনি নতুন নিয়োগ প্রক্রিয়াও থেমে ছিল অনেকদিন।
আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা আইএলও ২০২০ সালে বলেছিল, কোভিডের কারণে বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও বেকারত্ব বেড়েছে এবং দেশের তরুণদের এক চতুর্থাংশ বেকার বলে সংস্থাটি জানিয়েছিল।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক সায়মা হকের নেতৃত্বে ২০২১ সালের জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি মাসে চালানো এক জরিপে দেখা গেছে, কোভিডের কারণে দেশে চাকরিচ্যুতি এবং কর্মহীনতা বেড়েছে। ওই জরিপে দেখা গিয়েছিল, মহামারির প্রথম কয়েকমাসে দেশে অনেক মানুষ চাকরি হারিয়েছেন। এর মধ্যে সর্বোচ্চ বরিশালে প্রায় ১৩ শতাংশ মানুষ, ঢাকায় প্রায় পৌনে আট শতাংশ মানুষ চাকরি হারিয়েছেন।
চাকরি হারানো মানুষেরা সবাই নতুন করে চাকরির বাজারে ঢুকতে পারেননি, অনেকেই স্থায়ীভাবে শহর ছেড়ে গ্রামে ফেরত গেছেন। যদিও দেশে কর্মহীন মানুষের সংখ্যা ঠিক কত সে বিষয়ে সরকারি কোন পরিসংখ্যান এখনো পাওয়া যায় না।
এদিকে, ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরাম তাদের গ্লোবাল রিস্ক রিপোর্ট ২০২২ এ বলেছে, ২০২২ সালে বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য সবচেয়ে বড় ঝুঁকি হচ্ছে কর্মসংস্থান এবং জীবিকার সংকট। অধ্যাপক সায়মা হকও মনে করেন, অর্থনীতির সংকট কাটাতে নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টির বিকল্প নেই।