প্রথম আলোর জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক রোজিনা ইসলাম একজন খ্যাতিমান সাংবাদিক। তিনি তাঁর সহকর্মীদের মধ্যে অত্যন্ত সম্মানিত। তিনি তাঁর সাহসী ও অন্তর্দৃষ্টিপূর্ণ প্রতিবেদনের জন্য পরিচিত। তাঁর জামিন আবেদনের ওপর আগামীকাল শুনানি হবে। তিনি কোন অপরাধে আগামীকাল পর্যন্ত কারাগারে থাকবেন? সিদ্ধান্তটি দিয়েছেন বিজ্ঞ আদালত। যেহেতু বিচার বিভাগের প্রতি আমাদের সর্বোচ্চ শ্রদ্ধা রয়েছে, তাই আমরা এই সিদ্ধান্ত নিয়ে প্রশ্ন করি না। তবে আইনটি আরও ভালোভাবে বোঝার দৃষ্টিভঙ্গি থেকে এ–সম্পর্কিত কয়েকটি প্রশ্ন উত্থাপন করছি।
১. বিচার সম্পন্ন হওয়ার আগে কেউ যাতে ভোগান্তি বা শাস্তির শিকার না হন, তা নিশ্চিত করার জন্য জামিনের বিধান রয়েছে। রোজিনা এক শিশুসন্তানের মা। তিনি অসুস্থ। মানসিক আঘাত ও অপমান নিয়ে তিন দিন কারাগারে থাকবেন তিনি। তাহলে এক মিনিটও বিচার হওয়ার আগে রোজিনাকে কি শাস্তি দেওয়া হচ্ছে না?
২. আইন অনুযায়ী, তিনটি সুস্পষ্ট কারণ রয়েছে—যার ভিত্তিতে জামিন নাকচ করা যেতে পারে:
ক. অভিযুক্ত ব্যক্তি মামলার সাক্ষ্যপ্রমাণে অবৈধ হস্তক্ষেপ করতে পারেন,
খ. অভিযুক্ত ব্যক্তি সাক্ষীদের হুমকি দিতে পারেন এবং তাঁর মাধ্যমে বিচারিক প্রক্রিয়া ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে,
গ. অভিযুক্ত ব্যক্তি পালিয়ে যেতে পারেন এবং এভাবে আইনের নাগাল থেকে বাঁচতে পারেন।
এই কারণগুলোর বাইরে দেশের কোনো নাগরিকের জামিন অস্বীকার করার কোনো আইনগত ভিত্তি নেই। উল্লিখিত তিনটি শর্তের কোনোটিই রোজিনার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়। তিনি তিন দিন কারাগারে থাকবেন এবং তা হচ্ছে তাঁর জামিন শুনানি মুলতবি করার কারণে। গতকাল তাঁকে জামিন দেওয়া যেত।
১৮৯৮ সালের ফৌজদারি কার্যবিধির ৪৯৭ (১) ধারায় সুস্পষ্টভাবে বলা আছে, ‘কোনো অজামিনযোগ্য অপরাধের অভিযোগে অভিযুক্ত যেকোনো ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার বা পরোয়ানা ছাড়াই আটক করা হলে…তাঁকে আদালতে হাজির করা হলে, তাঁকে জামিনে মুক্তি দেওয়া যেতে পারে। তবে অভিযুক্ত ব্যক্তি যদি মৃত্যুদণ্ড বা যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডনীয় অপরাধে দোষী বলে বিশ্বাস করার যুক্তিসংগত কারণ থাকে, তাহলে অভিযুক্ত ব্যক্তিকে জামিন দেওয়া যাবে না।
‘তবে শর্ত থাকে যে আদালত ১৬ বছরের কম বয়সী যেকোনো ব্যক্তি বা এ–জাতীয় অপরাধে অভিযুক্ত যেকোনো নারী বা অসুস্থ বা জরাগ্রস্ত ব্যক্তিকে জামিনে মুক্তি দেওয়ার নির্দেশ দিতে পারেন।’
প্রথমত একজন নাগরিক হিসেবে, তারপর একজন নারী হিসেবে এবং শেষতক একজন অসুস্থ ব্যক্তি হিসেবে রোজিনা জামিন পাওয়ার অধিকারী। বিজ্ঞ বিচারকের প্রতি যথাযথ শ্রদ্ধা রেখে, আমরা আবার বলছি, আমরা বিচার বিভাগকে সর্বোচ্চ শ্রদ্ধার জায়গায় রেখে বলছি, রোজিনার মামলার ক্ষেত্রে ৪৯৭ ধারার বিধানটি কীভাবে অনুসরণ করা হয়েছে, তা জানতে চাওয়া কি আমাদের ভুল হবে?
ব্যারিস্টার তানজিব–উল আলমের মতে, অভিযুক্ত হওয়ার পর এবং তা যদি অজামিনযোগ্যও হয়, তবু একজন নারীর জামিন চাওয়ার অধিকার আছে। অপরাধীদের বিচার প্রবিধানের ৪৯৭ নম্বর ধারায় এটি স্পষ্ট করা আছে। একজন ব্যক্তি যদি পালিয়ে না যান, প্রমাণাদি ধ্বংস বা সাক্ষীদের ভয় দেখিয়ে না থাকেন, এ ধরনের ব্যক্তিকে জামিন দেওয়া হয়েছে—বাংলাদেশ ও ভারতের সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগে, এমনকি আপিল বিভাগেও এমন বেশ কিছু বিচারিক সিদ্ধান্তের নজির রয়েছে।
আইনটি অবশ্য যথেষ্ট স্পষ্ট নয়। যদিও আইন পুরোপুরি তাঁর পক্ষে থাকার পরও রোজিনাকে জামিন পাওয়ার জন্য ধুঁকতে হচ্ছে। আবারও আমরা বিজ্ঞ বিচারককে প্রশ্ন করছি না, তবে আন্তরিক আবেদন জানাচ্ছি, আইন মেনে চলা নাগরিক হিসেবে আমরা পুরোপুরি বিভ্রান্ত যে কীভাবে আমাদের আইন বোঝা এবং বিচার চাওয়া উচিত।
দণ্ডবিধি ১৮৬০-এর ৩৭৯ ও ৪১১ ধারা এবং অফিশিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্ট ১৯২৩-এর ৩ ও ৫ ধারায় রোজিনা ইসলামের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়েছে।
দণ্ডবিধি দিয়ে সাধারণত চোরের বিচার করা হয়। রোজিনা আসলে কী চুরি করেছেন? তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়েছে, তিনি মুঠোফোন ব্যবহার করে কিছু ছবি তুলেছেন। এই ফোন এখন পুলিশের হেফাজতে রয়েছে। কিন্তু তিনি যা করেছেন, পেশাদার সাংবাদিক হিসেবে এবং দেশের জনগণের স্বার্থে করেছেন। সেখানে তাঁর ব্যক্তিগত কোনো স্বার্থ নেই, সাংবাদিকতা এবং জনস্বার্থে করেছেন।
অফিশিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্টের ৩ ধারাটিতে ‘গুপ্তচরবৃত্তির’ বিষয়টি উল্লেখ রয়েছে। এই গুপ্তচরবৃত্তি তখনই সংঘটিত হয়, যখন কেউ তথ্য সংগ্রহ করেন এবং তা ‘শত্রু’দেশের হাতে তুলে দেন।
কিন্তু এখানে এমন কোনো ঘটনা ঘটেনি। এই আইনের ধারা ৫-এ ‘সংরক্ষিত এলাকায় প্রবেশ’ এবং ‘কর্মকর্তাদের বেআইনি যোগাযোগের’ বিষয়টি উল্লেখ করা হয়েছে। আবারও বলতে হচ্ছে, একান্ত সচিবের কক্ষ ‘সংরক্ষিত’ এলাকা নয় এবং সেখানে বেআইনি কিছু করা হয়নি। এমনকি রোজিনা সেখানে এমন কিছুই করেননি, যার জন্য তাঁকে হেনস্তা করা যায়।
আমরা জোর দিয়ে বলতে চাই, বাক্স্বাধীনতাবিরোধী এবং বিতর্কিত আইনগুলোর মধ্যে অন্যতম অফিশিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্ট-১৯২৩, যা এখনো বিদ্যমান। এই আইন আমাদের সংবিধানের মূলনীতির সঙ্গে সাংঘর্ষিক। যুক্তিসংগত বিধিনিষেধের মাধ্যমে আমাদের সংবিধানের ৩৯ অনুচ্ছেদে মতপ্রকাশের স্বাধীনতার বিষয়টি নিশ্চিত করা হয়েছে। এ ছাড়া এই আইন তথ্য অধিকার আইনের (আরটিআই) সঙ্গে সরাসরি সাংঘর্ষিক। এই আইনে সরাসরি উল্লেখ করা হয়েছে, এর ধারার সঙ্গে সাংঘর্ষিক যেকোনো আইনের চেয়ে অগ্রাধিকার পাবে আরটিআই। এর অর্থ হলো, আরটিআই যত দিন আছে, তত দিন অফিশিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্ট কার্যকর হবে না বা আরটিআই দ্বারা এটি রহিত হবে।
বাংলাদেশের সাংবাদিকেরা দীর্ঘদিন এই আইনের বিরুদ্ধে লড়াই করেছেন। আমরা মনে করি, এই আইন এমন, যার মাধ্যমে অস্বচ্ছতা, জবাবদিহির ঘাটতি ও দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি এবং জনগণের অর্থ তছরুপের বিষয়গুলোকে উৎসাহিত করে।
এখানে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের দুর্নীতিসংক্রান্ত রোজিনা ইসলামের দুটি প্রতিবেদনকে উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করা যেতে পারে। ১৮ মে তাঁর একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। শিরোনাম ‘এখন এক কোটি দেব, পরে আরও পাবেন’। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের ১ হাজার ৮০০ কর্মী নিয়োগ নিয়ে এই প্রতিবেদন। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নিয়োগ কমিটির দুই সদস্য স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের সচিবের কাছে লিখিত অভিযোগ করেছেন, এই নিয়োগে লিখিত পরীক্ষায় পাস করিয়ে দেওয়ার বিনিময়ে কিছু প্রার্থীর কাছ থেকে ১৫ থেকে ২০ লাখ টাকা করে নেওয়া হয়েছে। এই তথ্য বেরিয়ে এসেছে মৌখিক পরীক্ষা নিতে গিয়ে। ৬০ থেকে ৭০ শতাংশ নম্বর পাওয়া ওই প্রার্থীরা মৌখিক পরীক্ষায় প্রশ্নের উত্তর দিতে পারেননি।
রোজিনা ইসলামের দ্বিতীয় প্রতিবেদনটি ছিল ‘৩৫০ কোটি টাকার জরুরি কেনাকাটায় অনিয়ম’। এই প্রতিবেদনে তুলে আনা হয়েছিল চিকিৎসা সরঞ্জাম ও স্বাস্থ্য সুরক্ষাসংশ্লিষ্ট যন্ত্রপাতি কেনা হয়েছিল কোনো চুক্তি ছাড়াই। এ ছাড়া অন্যান্য অনিয়মের বিষয়টিও উঠে আসে, যে বিষয়ে কেন্দ্রীয় ঔষধাগারের পরিচালক চলতি বছরের ৯ ফেব্রুয়ারি লিখিত অভিযোগ করেছিলেন।
রোজিনা ইসলামের এসব সাহসী অনুসন্ধানমূলক সাংবাদিকতায় কারা লাভবান হচ্ছিলেন, সেটি একটি স্বাভাবিক প্রশ্ন। আমরা মনে করি, এটি নিঃসংশয় যে এতে করদাতারা লাভবান হয়েছেন, কারণ তাঁদের কষ্টে অর্জিত দেওয়া অর্থ থেকেই এই দুর্নীতি হচ্ছিল। তাত্ত্বিকভাবে, একটি সরকার, যারা কিনা সুশাসন এবং জনগণের অর্থের ন্যায্য ব্যবহার নিশ্চিতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ থাকে, সেটিও এতে ব্যাপকভাবে লাভবান হয়েছে।
রোজিনা যা–ই করেছিলেন, তাতে জনগণ ও সরকার লাভবান হয়েছে। এটি নিশ্চিত, ওই নথিগুলো, যা জনসাধারণ ও সরকারের জবাবদিহির প্রক্রিয়াকে উপকৃত করছিল, সেগুলো কোনো সরকারি কর্মকর্তা স্বেচ্ছায় রোজিনাকে দেননি। তিনি যেভাবে হোক সেগুলো পেয়েছিলেন এবং তাঁর কাজের উদ্দেশ্য ছিল জনগণের কল্যাণ। রোজিনা যা করেছিলেন, তার মধ্যে ব্যক্তিগত কোনো বিষয় ছিল না এবং তাঁর সেই কাজে উপকার হচ্ছিল করদাতা জনসাধারণের।
আমরা বিচার বিভাগ, সরকার ও সংশ্লিষ্ট সবার কাছে একটি বিষয় বিবেচনা করার আবেদন জানাই, সাংবাদিকতা জনমানুষের কল্যাণের নিবেদিত একটি পেশা। এ ধরনের অনুসন্ধানমূলক সাংবাদিকতা না থাকলে আমাদের দেশ আরও বেশি দুর্নীতিতে ডুবে যাবে এবং আমাদের সীমিত সম্পদের অপব্যবহার হবে। যেকোনো সমাজের এগিয়ে যাওয়ার জন্য এ ধরনের সাংবাদিকতা সব সময়ই প্রয়োজন। এই মহামারিকালের কথা চিন্তা করলে অর্থনৈতিক, সামাজিক ও আরও নিখুঁতভাবে বললে, অন্যান্য অস্তিত্বের সংকট মোকাবিলায় এ ধরনের সাংবাদিকতা আরও বেশি প্রয়োজন।
(দ্য ডেইলি স্টারে প্রকাশিত মন্তব্য প্রতিবেদন থেকে অনূদিত)
মাহ্ফুজ আনাম : সম্পাদক, দ্য ডেইলি স্টার