নিউজ ডেস্ক: মৌলভীবাজারের কুলাউড়ার শতবর্ষী ঐতিহ্যবাহী দ্বীনি শিক্ষা-প্রতিষ্ঠান জালালীয়া দাখিল মাদরাসায় ফের উত্তপ্ত পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে লঙ্কাকাণ্ড তৈরি হয়েছে। মাদরাসাকে রক্ষাকল্পে বিভিন্ন অনিয়ম, দুর্নীতির বিরুদ্ধে ও সুপার আব্দুস শহীদকে অপসারণের দাবিতে মানববন্ধন করেছে স্থানীয় সচেতন এলাকাবাসী ও অভিভাবকরা। এসময় তাদের সঙ্গে একাত্মতা পোষণ করে মাদরাসার প্রাক্তন ও বর্তমান ছাত্র-ছাত্রীরা।
শনিবার সকাল ১১টায় মাদরাসার প্রধান ফটকের সামনে অনুষ্ঠিত মানববন্ধনে অংশ নেন এলাকার প্রবীণ মুরব্বি আব্দুল বাছিত লেবু, পাখি মিয়াসহ মাদরাসার সাবেক ও বর্তমান ছাত্র-ছাত্রীরা। সেই বিতর্কিত সুপার আব্দুস শহীদকে দায়িত্ব বহাল রাখার চেষ্টার প্রতিবাদে শিক্ষার্থী ও স্থানীয় এলাকাবাসীর আয়োজনে মানবন্ধনকে কেন্দ্র করে এই সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে।
সংঘর্ষে দুপক্ষের আহত হয়েছেন ৪ জন। মানববন্ধনের এক পর্যায়ে মাদরাসার ভেতরে দুপক্ষের মধ্যে হঠাৎ সংঘর্ষ শুরু হলে ব্যাপক উত্তেজনার সৃষ্টি হয়। এতে আতঙ্কিত হয়ে সাধারণ শিক্ষার্থীরা মাদরাসা থেকে ভয়ে বাড়িতে চলে যায়। এসব ঘটনায় উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসার মো. আনোয়ারকে প্রধান করে তিন সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছে উপজেলা প্রশাসন।
সরেজমিন মাদরাসায় গেলে জানা যায়, মাদরাসার স্থগিত কমিটির শিক্ষানুরাগী সদস্য সুয়েব আহমদ, সিনিয়র শিক্ষক আব্দুস সামাদের শ্যালক এলাইছ মিয়া, সিএনজি চালক শাহীন আহমদসহ প্রায় ১০-১২ জনের একটি দল লাঠিসোটাসহ ভারপ্রাপ্ত সুপার মুজিবুর রহমানের ওপর অতর্কিত হামলা চালায়। হামলায় সুপার মুজিবুর রহমানসহ মাদরাসার আরেক শিক্ষক মাওলানা আব্দুস ছালাম আহত হন। পরে তাদের স্থানীয়রা উদ্ধার করে কুলাউড়া হাসপাতালে ভর্তি করেন। এ সময় বহিরাগতরা ও মাদরাসার সাবেক-বর্তমান শিক্ষার্থীরা উত্তেজিত হয়ে একটি মোটরসাইকেলসহ মাদরাসার একটি কক্ষের আসবাবপত্র ভাঙচুর করে। এ ঘটনায় মাদরাসার শিক্ষক সামাদ আহমদ, করণিক আলাউদ্দিন আহমদও আহত হন। তবে প্রত্যক্ষদর্শী অনেকেই জানান, মাদরাসার করণিক আলাউদ্দিন আহমদ মাদরাসার বর্তমান ভারপ্রাপ্ত সুপারের ওপর দোষ চাপাতে নিজে তাঁর লোকজন দিয়ে সাইকেল ভাঙচুর করান।
খবর পেয়ে কুলাউড়া থানা পুলিশের এস আই মাসুদ আলম ও আব্দুর রহিমের নেতৃত্বে একদল পুলিশ ঘটনাস্থলে গিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনেন। এরপর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা এ টি এম ফরহাদ চৌধুরী ও কুলাউড়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. ইয়ারদৌস হাসান মাদরাসায় উপস্থিত হয়ে ঘটনার সত্যতা পান। তখন তারা মাদরাসার শিক্ষক, স্থানীয় গণ্যমান্যদের নিয়ে আলোচনায় বসেন। এবং মাদরাসার স্বাভাবিক পরিস্থিতি না ফেরার আগ পর্যন্ত মাদরাসার সুপার আব্দুস শহীদ, বর্তমান ভারপ্রাপ্ত সুপার মুজিবুর রহমান, সিনিয়র শিক্ষক আব্দুস সামাদ ও করণিক আলাউদ্দিন আহমদকে মাদরাসায় সাময়িক না আসতে নির্দেশনা প্রদান করেন।
এদিকে মাদরাসার স্থগিত কমিটির সভাপতি, আওয়ামী লীগ নেতা, কুলাউড়া ইয়াকুব তাজুল মহিলা বিশ্ববিদ্যালয় কলেজের অধ্যক্ষ মো. আব্দুর রউফের বিভিন্ন নাটকিয়তা ও ছলচাতুরীর কারণে এই শতবর্ষী মাদরাসা আজ ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে এসে পৌঁছেছে বলে মনে করছেন স্থানীয় সচেতন মহল। তাঁর একচ্ছত্র ক্ষমতার প্রভাবে বিতর্কিত ব্যক্তি আব্দুস শহীদকে মোটা অংকের টাকার বিনিময়ে মাদরাসার সুপারের দায়িত্ব দেওয়া হয়। তাঁর দাপটের কারণে মাদরাসার সকল শিক্ষককে সবসময় তটস্থ থাকতে হয়। ভয়ে কেউ কিছু বলার সাহস পায় না। পূর্বের মতো এবার প্রকাশ্য ইন্ধনে মাদরাসায় ফের উত্তপ্তকর পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে।
মাদরাসার এক ছাত্রীকে যৌন নিপীড়নের ঘটনায় অভিযুক্ত সুপার মাওলানা আব্দুস শহীদ দুই মাস কারাবরণ শেষে বৃহস্পতিবার জামিনে ফিরলে মাদরাসা নিয়ে গভীর ষড়যন্ত্র শুরু হয়। তাকে ফের সুপারের দায়িত্বে বসানোর পায়তারায় লিপ্ত হন মাদরাসার স্থগিত কমিটির সভাপতি অধ্যক্ষ মো. আব্দুর রউফ, সিনিয়র শিক্ষক আব্দুস সামাদ, করণিক আলাউদ্দিন আহমদসহ একাধিক ব্যক্তি।
মাদরাসা নিয়ে তাদের গভীর ষড়যন্ত্রের গোপন ফোনালাপ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকসহ বিভিন্ন মহলে ফাঁস হলে এ নিয়ে স্থানীয় এলাকায় ব্যাপক উত্তেজনার সৃষ্টি হয়। এবং বিভিন্ন মহলে সমালোচনা শুরু হয়। সুপার শহীদকে ফের দায়িত্বে আনার জন্য অধ্যক্ষ আব্দুর রউফ উঠেপড়ে লেগেছেন। তিনি মাদরাসা সিনিয়র শিক্ষক আব্দুস সামাদের সঙ্গে গোপন ফোনালাপ করেন। ফোনালাপে অধ্যক্ষ আব্দুর রউফ মাদরাসার শিক্ষক আব্দুস সামাদকে নির্দেশ দেন যে, একটি মেয়ে রয়েছে, তাকে যেকোনো ভাবে মাদরাসায় ৫ম শ্রেণিতে ভর্তি করাতে হবে। সময় মতো তাকে দিয়ে ভারপ্রাপ্ত সুপার মুজিবুর রহমানকে যৌন হয়রানির অভিযোগে অভিযুক্ত করে হেনস্তা করা হবে।
শিক্ষক সামাদ বলেন, স্যার কিভাবে কি করব, সব কাগজপত্র তো মুজিবুর রহমানের কাছে। তখন আব্দুর রউফ বলেন, ভারপ্রাপ্ত সুপার মুজিবুর রহমান কিছু করতে পারবে না, তোমরা একটু ধৈর্য ধর। তুমি মাদরাসার করণিক আলাউদ্দিনের সঙ্গে যোগাযোগ করো। সে ভর্তি করাবে। আরেক প্রশ্নে সামাদ বলেন, স্যার সুপার হুজুরের জামিনের কোনো ব্যবস্থা করা যাবে কি। তখন রউফ বলেন, খুব শিগিগরই তার জামিন হবে। আরেক ফোনালাপে শিক্ষক সামাদ ও করণিক আলাউদ্দিনের কথা হয়। সামাদ বলেন মাদরাসার সুপার শহীদকে অপসারণ করার জন্য বর্তমান ভারপ্রাপ্ত সুপার দৌঁড়ঝাপ শুরু করছেন।
প্রতিনিয়ত উপজেলা শিক্ষা অফিসে যাতায়াত করছেন। তখন আলাউদ্দিন বলেন, শহীদ হুজুরকে নয় বর্তমান ভারপ্রাপ্ত সুপারকে অপসারণ করব। কথার একপর্যায়ে তারা বলে, উপজেলা প্রশাসন কিভাবে কমিটি বাতিল করবে, যেখানে কোনো সভাপতি, সম্পাদক, এডহক কমিটি নেই। তখন আব্দুর রউফ বলেন, সুপার শহীদ জেল থেকে বের হয়ে আসলে আমরা সবাই বসে সভা করে বর্তমান ভারপ্রাপ্ত সুপার মুজিবুর রহমানকে অপসারণ করব। তোমরা সবাই একটু ধৈর্য ধর। এমনসব ষড়যন্ত্রের খবর পেয়ে গত ১১ মার্চ ভারপ্রাপ্ত সুপার মাওলানা মুজিবুর রহমান কুলাউড়া থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি করেন।
স্থানীয় এলাকার বাসিন্দা ও ইউপি সদস্য মো. ছালিক আহমদ বলেন, এই শতবর্ষী মাদরাসাটি অনেক ঐতিহ্যর। কিন্তু মাদরাসার শিক্ষকদের মধ্যে দ্বন্দ্ব থাকার কারণে আজ মাদরাসাটি ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে। এলাকার সর্বস্তরের মানুষ মাদরাসার পক্ষে অবস্থান রয়েছে। অতীতে কখনো মাদরাসা নিয়ে কেউ কোনো ধরনের ঘটনা ঘটাতে পারেনি। কিন্তু বর্তমানে কিছু শিক্ষকদের কারণে এইসব সমস্যার তৈরি হয়েছে। শতবর্ষী মাদরাসার স্বাভাবিক অবস্থা ফিরিয়ে আনার জন্য এলাকাবাসীর পক্ষ থেকে উপজেলা প্রশাসনের কাছে জোর দাবি জানাচ্ছি প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য।
এ বিষয়ে মাদরাসার স্থগিত কমিটির সভাপতি অধ্যক্ষ মো. আব্দুর রউফ বলেন, দুই মাস ধরে আমি মাদরাসার ধারে কাছে নেই। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষায় প্রশাসনকে বলা হয়েছে, তারা প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবে। আর ভয়েস রেকর্ডের বিষয়ে আমি কিছুই জানি না। আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠতে পারেই, তাই বলে কি সবকিছু কি সঠিক। আমি চাই প্রশাসনের সহযোগিতায় এলাকার সবাইকে নিয়ে মাদরাসার স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে আসুক।
কুলাউড়া থানার অফিসার ইনর্চাজ মো. ইয়ারদৌস হাসান বলেন, অভিযোগ প্রাপ্তির সাপেক্ষে প্রয়োজনীয় আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
এ ব্যাপারে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা এ টি এম ফরহাদ চৌধুরী বলেন, সরেজমিন পুলিশ প্রশাসনসহ ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছি। মাদরাসা নিয়ে শিক্ষকদের মধ্যে আন্তরিকতার অনেক ত্রুটি রয়েছে। মাদরাসার স্বাভাবিক অবস্থা ফিরিয়ে আনতে এই ঘটনার সঠিক তদন্তের জন্য উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা অফিসারকে প্রধান করে তিন সদস্যবিশিষ্ট তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। তদন্ত কমিটি কর্তৃক আগামী তিন দিনের মধ্যে চূড়ান্ত রিপোর্ট পাওয়া সাপেক্ষে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।