নিউজ ডেস্ক: সুইডেনের এক ব্যস্ত রাজপথে এক শুক্রবার রাতে আততায়ীর গুলিতে প্রাণ হারান দেশটির সাবেক প্রধানমন্ত্রী উলফ প্যালমে
সুইডেনের সাবেক প্রধানমন্ত্রী উলফ প্যালমেকে ১৯৮৬ সালে কে খুন করেছিল, ৩৪ বছর পর সেই রহস্য উদঘাটন করা হয়েছে।
সুইডিশ কৌঁসুলিরা জানিয়েছেন আততায়ীর নাম স্টিগ এংগস্ট্রম যে “স্ক্যানডিয়া ম্যান” নামেও পরিচিত ছিল। ২০০০ সালে সে আত্মহত্যা করে।
উলফ প্যালমে তার স্ত্রীকে নিয়ে সিনেমা দেখে যখন বাসায় ফিরছিলেন তখন স্টকহোমের রাস্তায় তাকে পেছন থেকে গুলি করা হয়।
তার সাথে কোন নিরাপত্তা রক্ষী ছিল না। তিনি খুন হন সুইডেনের সবচেয়ে ব্যস্ত রাজপথে এবং জনা বারো মানুষ দেখেছিল এক ব্যক্তি গুলি করে ছুটে পালাচ্ছে।
হাজার হাজার মানুষকে এই খুনের ঘটনায় জেরা করা হয়। এক ছিঁচকে অপরাধীকে দোষী সাব্যস্ত করা হয়। পরে আবার সেই রায় নাকচ করে দেয়া হয়।
প্রধান কৌঁসুলি ক্রিস্টার পিটারসন এক সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, “স্টিগ এংগস্ট্রম যেহেতু বেঁচে নেই, তাই তার বিরুদ্ধে আমরা অভিযোগ গঠন করতে পারব না। তাই এই তদন্তের এখানেই ইতি টানার সিদ্ধান্ত আমরা নিয়েছি।”
তিনি বলেছেন, এই খুনের তদন্তে প্রথমে স্টিগ এংগস্ট্রমকে সন্দেহ করা হয়নি। কিন্তু যখন তার নাম সন্দেহভাজনদের তালিকায় আসে, তখন তারা জানতে পারেন সে আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহারে দক্ষ, কারণ সে সেনাবাহিনীতে ছিল এবং একটি শ্যুটিং ক্লাবের সদস্য ছিল।
শুধু তাই নয়, উলফ প্যালমের বামপন্থী নীতির বিরোধী ছিলেন এংগস্ট্রম এবং তার নিজের এলাকায় সাবেক প্রধানমন্ত্রীর সমালোচক এক গোষ্ঠীর সঙ্গে তার যোগাযোগ ছিল।
কী ঘটেছিল সে রাতে?
সেটা ছিল ৩৪ বছর আগে শুক্রবারের এক রাত। ২৮শে ফেব্রুয়ারি ১৯৮৬। সুইডেনের প্রধানমন্ত্রী গিয়েছিলেন সিনেমা দেখতে।
বিতর্কিত এবং স্পষ্টবক্তা উলফ প্যালমে তখন দ্বিতীয় মেয়াদে সুইডেনের প্রধানমন্ত্রী। কিন্তু তিনি যতটা সম্ভব সাধারণ মানুষের মত থাকতে পছন্দ করতেন। প্রায়ই তিনি বাইরে বেরনর সময় পুলিশি নিরাপত্তা নিতে অপছন্দ করতেন।
সে রাতেও তিনি কোন পুলিশ বা রক্ষী নেননি। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে বাসায় ফিরে নিরাপত্তা রক্ষীদের বিদায় দেন তিনি। স্ত্রী লিসবেট বলেন সিনেমা দেখতে যাবার কথা।
উলফ প্যালমে ও তার স্ত্রী লিসবেট। তাদের বিয়ে হয় ১৯৫৬ সালে
ছেলে মার্টেনের সাথে কথা বলেন। আগে থেকেই তার আর তার বান্ধবীর একটা কমেডি সিনেমার জন্য সে রাতে টিকিট কাটা ছিল।
মি. প্যালমে স্ত্রীকে নিয়ে বেরিয়ে পড়েন গণপরিবহনে সিনেমা হলের উদ্দেশ্যে। পাতাল রেলে চড়ে পুরনো শহর এলাকা থেকে শহর কেন্দ্রে গিয়ে নামেন তারা। সিনেমা হলের বাইরে ছেলে ও তার বান্ধবীর সঙ্গে দেখা করেন রাত ন’টা নাগাদ।
সিনেমা দেখে বেরনর পর সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও তার স্ত্রী ব্যস্ত রাজপথ ধরেন। ছেলে ও ছেলের বান্ধবী চলে যান অন্য পথে। রাত তখন প্রায় সাড়ে এগারোটা। দুজনে হেঁটে বাসায় ফিরছিলেন।
ব্যস্ত এক রাস্তার মোড়ে একজন দীর্ঘদেহী মানুষ হঠাৎই পেছনে এসে খুবই কাছ থেকে দুবার গুলি চালায়। আততায়ীর একটা গুলি লাগে মি. প্যালমের পিঠে। অন্য গুলি লাগে লিসবেটের গায়ে।
আততায়ী ছুটে পালায়। পাশের এক রাস্তার সিঁড়ি বেয়ে ওঠে, তারপর মিলিয়ে যায়।
মি. প্যালমে মাটিতে পড়ে যাবার আগেই মারা যান।
সুইডেনের মানুষ ঘটনার আকস্মিকতায় স্তম্ভিত হয়ে যায়। সেসময় ১২বছরের কিশোরী ছিলেন শার্লোত্তা ওয়ালস্টেন। তার মনে আছে বাবা তাকে পরদিন সকালে বলেছিলেন “সাংঘাতিক একটা ঘটনা ঘটেছে”।
“আমরা টিভি খুলে দেখলাম প্রকাশ্য রাস্তায় ওই খুনের খবর। সারা দেশ স্তব্ধ হয়ে গিয়েছেল।” তিনি বলছেন সুইডেনে এমন ঘটনা ঘটতে পারে মানুষ বিশ্বাস করতে পারছিল না।
সুইডেনের ব্যস্ততম রাস্তায় এই খুনের ঘটনা ঘটার পরও হত্যাকারীকে কখনই খুঁজে পাওয়া যায়নি, যদিও জনা বারোর বেশি লোক লম্বা চেহারার এক লোককে গুলি করে ছুটে পালাতে দেখেছিল।
পুলিশও এত হতবাক হয়েছিল যে তারা দ্রুত অপরাধের স্থল ঘিরে ফেলেনি, আততায়ী পালিয়ে যাবার কয়েক ঘন্টা পরেও শহর কেন্দ্রের সামান্য একটু এলাকা বন্ধ করে দেয়া হয়।
হত্যাকাণ্ডের পর রাস্তার সামান্য অংশ পুলিশ ঘিরে দিয়েছিল
রাস্তায় যেখানে মি. প্যালমের রক্ত পড়েছিল, শোকার্ত মানুষ সেখানে ফুল দিয়ে যায়। প্রত্যক্ষদর্শীদের জেরা করাও হয়নি সময়মত। অনেক প্রত্যক্ষদর্শী ভিড়ে হারিয়ে যায়। একজন পথচারী বেশ কয়েকদিন পর একটি বুলেট রাস্তা থেকে উদ্ধার করে।
যে আগ্নেয়াস্ত্র দিয়ে সাবেক প্রধানমন্ত্রীকে খুন করা হয়েছিল, সেটিও কখনও উদ্ধার কর যায়নি।
কে এই আততায়ী এংগস্ট্রম?
মি. এংগস্ট্রম স্ক্যানডিয়া নামে একটি বীমা কোম্পানিতে কাজ করতেন, যে কারণে পরে তাকে ‘স্ক্যানডিয়া ম্যান’ নামেও উল্লেখ করা হতো। ঘটনার দিন তিনি দেরি করে কাজ করছিলেন এবং তার অফিসের সদর দপ্তর ছিল ঘটনাস্থলের খুবই কাছে।
প্রত্যক্ষদর্শী হিসাবে পুলিশ তাকে যখন জেরা করে, তখন মি. এংগস্ট্রম খুনের ঘটনা সম্পর্কে মিথ্যা তথ্য দিয়েছিলেন, এমনকী তিনি বলেছিলেন তিনি মি. প্যালমেকে রিসাসিটেট করার চেষ্টা করেছিলেন।
দেশটির একটি পত্রিকাতে ২০১৭ সালে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে এংগস্ট্রমের সাবেক স্ত্রী জানান পুলিশ তাকেও জেরা করেছিল। তিনি তখন বলেছিলেন এংগস্ট্রম পুরো নির্দোষ।
“সে খুবই ভীতু প্রকৃতির, মানুষ মারা দূরের কথা, সে একটা মাছিও মারবে না,” বলেছিলেন মি. এংগস্ট্রমের সাবেক স্ত্রী।
পুলিশ বেশ কিছু মানুষকে জেরা করেও খুনের কোন কিনারা করতে পারেনি। যে বুলেটটি উদ্ধার করা হয়েছিল সেটি দেখে পুলিশ এটুকু বুঝেছিল খুবই শক্তিশালী আগ্নেয়াস্ত্র থেকে ওই গুলি ছোঁড়া হয়।
একজন কর্মকর্তা বলেন, সাবেক প্রধানমন্ত্রী বুলেটপ্রুফ ভেস্ট পরে থাকলেও তিনি মারা যেতেন। “কাজেই যে তাকে গুলি করেছিল, সে শুধু সুযোগ নিতে চায়নি, সে আসলেই পরিকল্পনা করে হত্যার উদ্দেশ্যেই গুলি চালিয়েছিল, ” তিনি বলেন।
এক ব্যক্তির জেল হয়েছিল। সে ছিল দাগী অপরাধী। ওই অপরাধীর নাম ছিল ক্রিস্টার পিটারসন (প্রধান কৌঁসুলির নামও এক- তবে অবশ্যই তারা আলাদা ব্যক্তি)। সন্দেহভাজন অপরাধীদের লাইন করে যখন হাজির করা হয়, তখন সাবেক প্রধানমন্ত্রীর স্ত্রী তাকে অপরাধী হিসাবে শনাক্ত করেছিলেন। ১৯৮৯ সালে তার যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয়েছিল।
পরে অবশ্য অল্পদিনের মধ্যেই এক আপিলে ওই রায় খারিজ করে দেয়া হয়। তার কোন উদ্দেশ্য প্রমাণিত হয়নি। তার কাছে কোন অস্ত্রও পাওয়া যায়নি। ওই ব্যক্তি ২০০৪ সালে মারা যায়।
মি. প্যালমে-র হত্যায় দোষ স্বীকার করেছিল ১৩০ জনের বেশি। এ তথ্য দিয়েছেন তদন্তকারী দলের প্রধান হান্স মেলান্ডার।
মি. প্যালমের শত্রু কারা ছিল?
মি. প্যালমে ছিলেন খুবই আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্ব, জনপ্রিয় প্রধানমন্ত্রী। সুইডেনের সোসাল ডেমোক্রাটিক পার্টির নেতা। বহু আন্তর্জাতিক বিষয়ে তিনি ছিলেন স্পষ্টবক্তা।
দেশের ভেতর তার সংস্কার কর্মসূচি ব্যবসায়ী মহলে তাকে অজনপ্রিয় করেছিল। তারা তার পদক্ষেপে ক্ষুব্ধ ছিল। তিনি পারমাণকি শক্তির বিরুদ্ধেও কথা বলতেন।
তিনি ১৯৬৮ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের চেকোশ্লোভাকিয়া দখলের সমালোচক ছিলেন। উত্তর ভিয়েতনামে আমেরিকার বোমা হামলা এবং দক্ষিণ আফ্রিকায় “ন্যাক্কারজনক” বর্ণবাদী সরকারের তিনি তীব্র সমালোচনা করেছেন।
আততায়ীর হাতে মি. প্যালমের খুনের ঘটনায় সুইডেন স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিল। তার মৃত্যু নানা ষড়যন্ত্র তত্ত্বের জন্ম দেয়
কিছু ষড়যন্ত্র তত্ত্ব
কয়েক দশক ধরে এই খুনের তদন্ত সুইডেনের পুলিশকে ব্যস্ত রেখেছিল।
বছরের পর বছর ধরে নানা ষড়যন্ত্র তত্ত্বের চর্চ্চা হয়েছে এই হত্যাকাণ্ড ঘিরে। কেন মি. প্যালমেকে খুন করা হয়েছিল তার যেসব কারণ তুলে ধরা হয়েছে:
তিনি দক্ষিণ আফ্রিকার বর্ণবাদী সরকারের বিরুদ্ধে সরব ছিলেন। তিনি আফ্রিকান ন্যাশানাল কংগ্রেস (এএনসি)কে অর্থ দিয়েছেন। সুইডেনের পুলিশ ১৯৯৬ সালে এই দাবি খতিয়ে দেখতে দক্ষিণ আফ্রিকা যায়।
মি. প্যালমে জেনে গিয়েছিলেন ভারতের সঙ্গে অস্ত্র চুক্তি করার জন্য সুইডেনের অস্ত্র কোম্পানি বোফর্স ভারতকে ঘুষ দিয়েছিল।
মি. প্যালমের সরকার কুর্দি জঙ্গী গোষ্ঠী পিকেকে-কে সন্ত্রাসবাদী বলে ঘোষণা করেছিল।
উলফ প্যালমের স্ত্রী লিসবেট প্যালমে মারা যান ২০১৮ সাল। তিনি জেনে যেতে পারেননি তার স্বামীর প্রকৃত খুনি কে ছিল।