নিউজ ডেস্ক: নিজের জমির ওপর হাসপাতাল গড়ে মৌলভীবাজার ও হবিগঞ্জের সাধারণ মানুষের স্বাস্থ্যসেবা দিয়ে আসছেন সত্তরোর্ধ্ব বদরুন্নেছা খানম। তাঁর দুই ছেলে প্রবাসে থাকার সময় হবিগঞ্জ শহরের রাজনগরে গড়ে তোলেন বদরুন্নেছা প্রাইভেট হাসপাতাল ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার। একপর্যায়ে হাসপাতালটি পরিচালনার দায়িত্ব দেন সাবেক ছাত্রলীগ নেতা এবং জেলা আয়কর আইনজীবী সমিতির সাধারণ সম্পাদক শেখ আনিসুজ্জামানকে। কিন্তু রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে তিনি এখন নিজেই মালিক সেজে হাসপাতালটি দখলের পাঁয়তারা করছেন।
বদরুন্নেছার অভিযোগ, ট্রেড লাইসেন্স ও হাসপাতালের লাইসেন্স জাল করে, হাসপাতাল পরিচালনার চুক্তি না মেনে আলাদা ব্যাংক হিসাব খুলে লেনদেন এবং ঋণ নিয়ে প্রায় ৯০ লাখ টাকা আত্মসাৎ করা হয়েছে। আর মূল মালিক বদরুন্নেছাকে না জানিয়ে হাসপাতালের নামে ৫০ লাখ টাকা ঋণ নেওয়া হয়েছে।
বদরুন্নেছা খানম হাসপাতালের আয়-ব্যয়ের হিসাব চাইলে তা দিতে অস্বীকৃতি জানান শেখ আনিসুজ্জামান। এসব নিয়ে বদরুন্নেছা খানম থানায় মামলা করতে গেলে রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে তা করতে দেননি। শেষে শেখ আনিসুজ্জামানকে প্রধান আসামি করে গত বছর ১১ নভেম্বর হবিগঞ্জ সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটের আমলি আদালতে ৯ জনের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেন তিনি। মামলার অন্য আসামিরা হলেন শেখ মোহাম্মদ আলী মাসুদ, আইডিএলসি ফাইন্যান্স লিমিটেডের সংশ্লিষ্ট শাখার হবিগঞ্জ শাখার ব্যবস্থাপক মো. ইকবাল শরীফ সাকি, একই ব্যাংকের কর্মকর্তা মো. রাশেদ আহমদ, ন্যাশনাল ব্যাংক লিমিটেড হবিগঞ্জ শাখার কর্মকর্তা রাশেদ কামাল সুমন, বদরুন্নেছা হাসপাতালের ব্যবস্থাপক তাছলিমা আক্তার বিউটি, কর্মচারী ইমতিয়াজ রহিম রুবেল, মো. তৌফিক মিয়া, হবিগঞ্জ সদর হাসপাতালের কনসালট্যান্ট ডা. মো. মজিবুর রহমান খান।
আদালতে বদরুন্নেছা খানমের দায়ের করা মামলার সূত্রে জানা গেছে, ২০১৪ সাল থেকে তিনি হাসপাতালটি একক মালিকানায় পরিচালনা করে আসছিলেন। হাসপাতালটি হবিগঞ্জ শহরের রাজনগরের মাস্টার কোয়ার্টার এলাকায়। পারিবারিক ব্যস্ততার কারণে তাঁকে অধিকাংশ সময় থাকতে হয় মৌলভীবাজারে। এ অবস্থায় ২০১৬ সালের ২৪ জুলাই হবিগঞ্জ শহরের কোরেশনগরের শেখ হায়দার আলীর ছেলে শেখ আনিসুজ্জামান ও রাজনগরের হাজি শেখ মো. সফর আলীর ছেলে শেখ মোহাম্মদ আলী মাসুদকে তাঁদের প্রস্তাবমতো হাসপাতালটি পরিচালনার দায়িত্ব দেন। এর জন্য লিখিত চুক্তিও করা হয়। হাসপাতালটি পরিচালনার জন্য বদরুন্নেছা খানম নিজের নামে ট্রেড লাইসেন্স এবং হাসপাতাল ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারের পৃথক লাইসেন্স করেন; যার নম্বর যথাক্রমে ২৯৬৫, ৪১৬৬ ও ৮৮০৩। চুক্তি অনুসারে বদরুন্নেছা খানম এবং পরিচালনার দায়িত্ব দেওয়া দুজনের একজনের স্বাক্ষরে প্রতিষ্ঠানের নামে ব্যাংক হিসাব খোলার কথা। কিন্তু শেখ আনিসুজ্জামান জালিয়াতি করে নিজের নামে ট্রেড লাইসেন্স করে এবং নিজেকে ওই প্রতিষ্ঠানের একক মালিক দেখিয়ে ন্যাশনাল ব্যাংক হবিগঞ্জ শাখায় এককভাবে লেনদেন করতে ২০১৮ সালের ১০ ডিসেম্বর ব্যাংক হিসাব খোলেন। ব্যাংক হিসাব খোলার সময় রাশেদ কামাল সুমন নামের এক ব্যক্তি শেখ আনিসুজ্জামানকে হাসপাতালের মালিক বলে শনাক্ত করেন। আর ড. মজিবুর রহমান খান শেখ আনিসুজ্জামানের নামে করা ট্রেড লাইসেন্স সত্যায়িত করেন।
বদরুন্নেছা খানম অভিযোগ করেন, উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে আনিসুজ্জামান এই জালিয়াতি ও প্রতারণার আশ্রয় নিয়েছেন। জাল ট্রেড লাইসেন্স ব্যবহার করে ওই হাসপাতালের নামে ন্যাশনাল ব্যংক হবিগঞ্জ শাখায় চলতি হিসাব খোলা হয়। এরপর বিভিন্ন তারিখে বেআইনিভাবে একক স্বাক্ষরে আনিসুজ্জামান ওই ব্যাংকে লেনদেন করেন। ওই ব্যাংকে হাসপাতালের সব আয় মামলার আসামি তাছলিমা আক্তার বিউটি, ইমতিয়াজ রহিম রুবেল ও তৌফিক মিয়ার মাধ্যমে জমা করা হয়। এভাবে প্রায় ৪০ লাখ টাকা শেখ আনিসুজ্জামান ও শেখ মোহাম্মদ আলী আত্মসাৎ করেছেন।
মামলার অভিযোগে আরো বলা হয়েছে, জাল কাগজপত্রের মাধ্যমে ন্যাশনাল ব্যাংক হবিগঞ্জ শাখার হিসাব নম্বর ব্যবহার করে ২০১৯ সালের জানুয়ারিতে আইডিএলসি ফাইন্যান্স লিমিটেড হবিগঞ্জ শাখা থেকে শেখ আনিসুজ্জামান হাসপাতালের নামে ৫০ লাখ টাকা ঋণ নিয়ে আত্মসাৎ করেন। ঋণ নেওয়ার বিষয়টি বদরুন্নেছা খানমকে অবহিত করা হয়নি। ঋণের টাকা উত্তোলনে সহায়তা করায় আইডিএলসি ফাইন্যান্স লিমিটেডের ওই শাখার কর্মকর্তা ইকবাল শরীফ সাকিকেও মামলায় আসামি করা হয়েছে।
ইকবাল শরীফ কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘হাসপাতালের পরিচালক শেখ আনিসুজ্জামানের মাধ্যমে ঋণ দেওয়া হয়েছে। চার মাস আগে এই ঋণ দেওয়া হয়। মালিক ও পরিচালকের দ্বন্দ্বে মামলায় আমার নাম জুড়ে দেওয়া হয়েছে। সালিসিতে সুরাহা না হওয়ায় বদরুন্নেছা মামলা করেছেন।’
জানা গেছে, মামলা দায়েরের পর আদালত এ ব্যাপারে সিআইডিকে তদন্ত করে প্রতিবেদন দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। সিআইডি বর্তমানে তদন্ত করছে। সিআইডি হবিগঞ্জের পরিদর্শক আব্দুর রাজ্জাক কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘প্রায় এক মাস ধরে তদন্ত করছি। সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের নথিপত্র জব্দ করা হয়েছে।’
জানা গেছে, ব্যাংকে জমা দেওয়া কাগজপত্রে হাসপাতালের মালিক হিসেবে বদরুন্নেছার নাম ফ্লুইড দিয়ে মুছে শেখ আনিসুজ্জামান নিজের নাম ব্যবহার করেছেন। সিআইডির তদন্তে অভিযোগের সত্যতা পাওয়া যাচ্ছে।
বদরুন্নেছার ছেলে ডা. আবদুল হাদী শাহীন কালের কণ্ঠকে জানান, তাঁর মা ও তিনি এখন প্রাণভয়ে আছেন।
এ বিষয়ে মন্তব্য জানতে মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করা হলে প্রধান আসামি শেখ আনিসুজ্জামান কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমার বিরুদ্ধে আনা সব অভিযোগ মিথ্যা। আমি নির্দোষ। একটি বন্ধ হাসপাতালে কোটি টাকার ওপর বিনিয়োগ করেছি। আমি কোনো জালিয়াতি করিনি। আদালত তাদের অভিযোগ তদন্ত করছে। আমার মানসম্মান আছে। বিষয়টি নিয়ে নাড়াচাড়া না করতে অনুরোধ করছি।’