নিউজ ডেস্ক: করোনায় লোকসানের ভারে এখন বন্ধের উপক্রম দেশের বেসরকারি এয়ারলাইন্স কোম্পানিগুলো। সেই সাথে চাকরির অনিশ্চয়তায় পড়েছেন এয়ারলাইন্সসহ অ্যাভিয়েশন খাতে জড়িত ৬৩ হাজার কর্মী। সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত ছয় মাসে সরকারি বেসরকারিসহ বিমান কোম্পানিগুলোর লোকসান হয়েছে প্রায় আড়াই হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে বাংলাদেশ বিমানের ১৭ শ’ কোটি, ইউএস বাংলার প্রায় ৪০০ কোটি, রিজেন্ট এয়ারওয়েজ ২০০ কোটি এবং নভো এয়ারের লোকসান ৬৯ কোটি টাকা। এর বাইরে সিভিল অ্যাভিয়েশন দেনা জমেছে শত শত কোটি টাকা। এ পরিস্থিতিতে কোনো কোনো এয়ারলাইন্স বন্ধ হয়ে যাওয়ার আশঙ্কাও করছেন কেউ কেউ।
তবে এর মধ্যে রাষ্ট্রীয় সংস্থা বিমান অল্পস্বল্প আয় করছে। শতাধিক পণ্যবাহী ও চার্টার্ড ফ্লাইট চালিয়ে গত তিন মাসে প্রায় আড়াই শ’ কোটি টাকা আয় করেছে বিমান। কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, এরই মধ্যে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স বিভিন্ন হারে তাদের কর্মীদের বেতন কমিয়েছে। আর বেসরকারি এয়ারলাইন্সগুলো তাদের কর্মীদের অবৈতনিক ছুটিতে পাঠিয়েছে। বাংলাদেশ বিমান আগে যেখানে বিশ্বের ১৭টি গন্তব্যে আন্তর্জাতিক ফ্লাইট পরিচালনা করত সেখানে এখন মাত্র দু’টি গন্তব্যে ফ্লাইট চালু আছে। বেসরকারি তিনটি এয়ারলাইন্সের মধ্যে একটির সকল কার্যক্রম এখনো বন্ধ রয়েছে। আর যা স্বল্প পরিসরে চালু আছে তা যাত্রী সঙ্কটে প্রস্তুতির পরও ফ্লাইট পরিচালনা করতে পারছে না।
বাংলাদেশ বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ বলছে, এ বছরের শুরু থেকে মার্চের মাঝামাঝি পর্যন্ত দেশে বিমান যাত্রী এসেছে প্রায় আট লাখের মতো কিন্তু এর পর থেকে জুনে বিমান চলাচল পুনরায় চালুর আগ পর্যন্ত মোটে ৩৪ হাজার যাত্রী এসেছে।
বেসামরিক বিমান পরিবহন মন্ত্রণালয়ের কাছে তাদের দেয়া তথ্য অনুযায়ী, জুন পর্যন্ত বেসরকারি বিমান সংস্থার মধ্যে রিজেন্ট এয়ারওয়েজের সকল প্রকার কার্যক্রমই বন্ধ রয়েছে। এর বাইরে ছয় মাসে ইউএস বাংলার প্রায় ৪০০ কোটি টাকা, রিজেন্ট এয়ারওয়েজ ২০০ কোটি টাকা এবং নভো এয়ারের ৬৯ কোটি টাকা লোকসান হয়েছে। রিজেন্ট তাদের সব কর্মীকে তিন মাসের অবৈতনিক ছুটিতে পাঠিয়েছিল যা সম্প্রতি সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে। শুধু মহামারী পূর্ববর্তী সময়ে বিক্রি হওয়া টিকিটের অর্থ ফেরত দেয়ার জন্য অল্প কিছু কর্মী কাজ করছেন।
অপর দিকে ইন্টারন্যাশনাল এয়ার ট্রান্সপোর্ট অ্যাসোসিয়েশন (আয়াটা) সম্প্রতি এক প্রতিবেদনে বলছে, করোনাভাইরাস মহামারীর কারণে বাংলাদেশে গত বছরের তুলনায় এই বছর বিমান যাত্রীর সংখ্যা গড়ে ৪৯ শতাংশ কম হবে। আয়াটার তথ্যানুযায়ী, বাংলাদেশে এখনো পর্যন্ত কোনো এয়ারলাইন্সে কর্মী ছাঁটাই না হলেও রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন বিমান কোম্পানি বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মীদের বেতন বিভিন্ন হারে কমিয়ে দিয়েছে। বিমান শ্রমিক লীগ বলছে গ্রাউন্ড হ্যান্ডলিংয়ের সাথে জড়িতদের বেতন কমানো হয়েছে ১৫ শতাংশ আর কর্মকর্তা পর্যায়ে কাটা হয়েছে ২০ শতাংশ। এসব কারণে বিমান খাতের সাথে নানাভাবে জড়িত ৬৩ হাজার কর্মীর চাকরি ঝুঁকিতে রয়েছেন।
বিরাজমান পরিস্থিতির বিষয়ে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, মহামারীর কারণে টানা আড়াই মাস বন্ধ থাকায় পর অভ্যন্তরীণ রুটে সীমিত পরিসরে চালু হয়েছে ফ্লাইট। তবে স্বাস্থ্য সুরক্ষার ৩৫ দফা নির্দেশনায় বেড়েছে খরচ। যদিও যাত্রী খরায় কমে গেছে আয়। বিভিন্ন দেশের নিষেধাজ্ঞার কারণে আন্তর্জাতিক রুটে সীমিত আকারে চালু ফ্লাইট অব্যাহত রাখাও অনেকটা অনিশ্চিত অবস্থায় আছে।
তিনি জানান, মার্চ থেকে জুন পর্যন্ত কোম্পানিটির ১৭০০ কোটি টাকার বেশি লোকসান হয়েছে। ফেব্রুয়ারিতে ক্যাপাসিটি লস ছিল ২৬ শতাংশ, যেটা মার্চের শেষে এসে দাঁড়িয়েছিল ৭৬ শতাংশ।
এর বাইরে মার্চের শেষে জুন পর্যন্ত সব কমার্শিয়াল অপারেশন বন্ধ হয়ে যায়। এরপর থেকে সীমিত আকারে শুধু চার্টার্ড ও কার্গো ফ্লাইট চালানো হচ্ছে। তবে সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্র এবং সপ্তাহে ঢাকা-লন্ডন একটি কমার্শিয়াল ফ্লাইট চালু হয়েছে। তবে সেখানে অনেক বাধ্যবাধকতা আছে। কোভিড- ১৯ বিষয়ক স্বাস্থ্যবিধির কারণে এই দু’টি গন্তব্যেও উড়োজাহাজের আসন অনুযায়ী যাত্রী নেয়া সম্ভব হচ্ছে না। কারণ সংশ্লিষ্ট সংস্থার নির্দেশনা হচ্ছে, বিমানের পেছনের দু’টি সারি খালি থাকতে হবে। যদি বিমান চলা অবস্থায় কেউ অসুস্থ হয় তাহলে তাকে সেখানে আইসোলেট করা হবে। আবার সিভিল অ্যাভিয়েশন বলছে পাশাপাশি দুইজন বসতে পারবে না।
অপর দিকে ইউএস-বাংলা এয়ারলাইন্সের মহাব্যবস্থাপক মো: কামরুল ইসলাম জানান, চলমান পরিস্থিতিতেই তারা এখন টিকে থাকার লড়াই করছেন। কারণ প্রতি মাসে তারা এখন শত কোটি টাকার আয় থেকে বঞ্চিত। তিনি জানান, এই মহামারীতে তারা বিভিন্ন দেশে আটকে পড়া বাংলাদেশী এবং বাংলাদেশে আটকে পড়া বিদেশীদের নিজ নিজ গন্তব্য পৌঁছাতে বিভিন্ন দেশে ৫৪টি ফ্লাইট পরিচালনা করেছেন। তবে বর্তমানে নিয়মিত একটি আন্তর্জাতিক ফ্লাইট এবং দেশের ভেতরে কক্সবাজার ছাড়া বাকি রুটগুলোতে ৩৬ থেকে ৩৮টি ফ্লাইট পরিচালনা করছেন। তিনি বলেন, এ অবস্থায় টিকে থাকতে হলে সরকার থেকে তাদের কিছু সহযোগিতা প্রয়োজন। এরমধ্যে অন্যতম হলোÑ অ্যরোনটিকাল, নন-অ্যরোনটিকাল চার্জেসগুলো আছে যেমন ল্যান্ডিং, পার্কিং, নিরাপত্তা, ন্যাভিগেশন এসবের চার্জগুলো আগামী পাঁচ বছরের জন্য মওকুফ। আর অপরটি হলো ফুয়েল কস্ট। বাংলাদেশে শুধু একটা কোম্পানির কাছ থেকে আমরা এটা কিনতে পারি। তাদের একটা মনোপলি আছে। জেট ফুয়েলের বাংলাদেশ ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে দামে ডিফারেন্স আছে। সেটা যেন একটা যৌক্তিক পর্যায়ে আসে। একটি এয়ারলাইন্সের অপারেশন কস্টের ৪০ শতাংশই হল জ্বালানি খরচ।