ফেসবুক থেকে: সফর ভাই মারা গেলেন সেদিন। আজ (শুক্রবার) তার জানাজা হয়ে গেল। প্রবাসে কেউ মারা গেলে প্রবাসীরা ঝাঁপিয়ে পড়ে লাশটি অনতিবিলম্বে লাশটি দেশের স্বজনদের কাছে পৌঁছে দিতে। মৃত ব্যক্তিটিকে অধিকাংশেরই চেনা নেই। কিন্তু লাশ প্রেরণ করতে নির্দিধায় অর্থ দান করেন। এটি একটি স্বাভাবিক অনুভূতি। আসলে প্রবাসীরা একে অপরের এক অদৃশ্য স্বজন হয়ে ওঠে অন্ততঃ মৃত্যুর পর।
সফর ভাই মারা গেলেন। স্বাভাবিকভাবেই তার নিকট-স্বজনদের খোঁজা হলো। প্যারিসে নেই। জানা গেলো, বড়ভাই স্বপরিবারে থাকেন লন্ডন! তার সাথে নাকি যোগাযোগ করা হলো। না, তার কাছে তার ভাইয়ের লাশটার সেরকম মূল্য নেই বলে তিনি মনোভাব প্রকাশ করলেন! দেশে তার স্ত্রীর সাথে যোগাযোগ করা হলো, তারাও ‘প্রাণহীন সফরের’ লাশটিকে একটি গুরুত্বহীন বোঝা-ই মনে করলো। আমার পরিচিত এবং সফর ভাইয়ের এলাকার (এবং সফর ভাইয়েরও পরিচিত) দুজন লোকের মাধ্যমে সফর ভাইয়ের স্ত্রীর সঙ্গে যোগাযোগ করলে সে লাশ গ্রহনের অপ্রয়োজনীয়তার মনোভাবটিই প্রকাশ করে! এমন কী বিসিএফ এর প্রধান নির্বাহী এমডি নূর ভাই এবং আরো একজন এক্সিকিউটিভ মেম্বার তার পরিবারের সাথে যোগাযোগ করলো। তারাও পূর্বোক্ত আচরণই পেয়েছেন বলে জানালেন। তারা চেষ্টা করছিলো সফর ভাইয়ের বৃদ্ধ মায়ের সাথে যোগাযোগ করার। কেননা মা নিশ্চয়ই সন্তানের লাশ না দেখে ছাড়বেন না। যোগাযোগ সম্ভব হয় নি।
কিন্তু সফর ভাইয়ের পারিবারিক পরিমন্ডলটি এরকম নয় বলেই আমি জানতাম। লন্ডনে তার বড় ভাইয়ের সাথে নিয়মিতই কথা হতো, যোগাযোগ হতো। পরিবারের সাথেও তার খারাপ কোন সম্পর্কের কথা জানা নেই। পারিবারিক অবস্থাও মোটামুটি ভাল বলেই জানতাম। তাহলে তার মৃত্যুর পর এই পটভূমির বেখাপ্পা অভিঘাত কেন?
শুনেছি সফর ভাইয়ের পরিবার ৫/৬ লাখ টাকা ঋণি আছেন। তার পরিবারটি এই ঋণ নিয়ে বেশি চিন্তিত!
কেমন একটি পরিবার সফর ভাই আপনার! এটিতো ভাবনারও অতীত! আসলে সকলের কাছে ‘জীবিত সফরদের’ মূল্য’ আছে, ‘মৃত সফর’ নয়। কেননা জীবিত সফররা রেমিট্যান্স পাঠাবে মাসের পর মাস। এর বাইরে কী তাদের আর জীবন আছে! প্রবাসে এই জীবিত সফর উদ্দিন তার হাই লেভেলের ডায়াবেটিস নিয়ে, মাইনাস তাপমাত্রার শীত আর পারদের ক্রমশঃ উল্লম্ফনের চামড়া পোড়া গরমে ১০/১১ ঘন্টা দাড়িয়ে দাড়িয়ে ফলের প্লাসে কাজ করেছে। পায়ের গোড়ালি ফুলে গেছে। ব্লাডের সুগার নেমে গেছে ভয়ংকরমাত্রায়। মৃত্যুর আগে বাংলাদেশী এক মালিকের রেস্টুরেন্টে কাজ করেছে। তাও তার জন্য খুব কষ্টের ছিলো বলে আমাকে জানিয়েছিলো। এভাবেই সে উপার্জন করে দেশে টাকা পাঠাতো। সংসার চলতো, দুটো ছেলেমেয়ের পড়াশুনা চালিয়ে গিয়েছিলো। দীর্ঘ ৩/৪ বছরে তার গায়ে একটি ভাল পোষাক দেখিনি। তার সাধ নিশ্চয়ই ছিলো, সাধ্য ছিলো না। নিজেকে সাজাতে গেলে যে সংসারে সমস্যা হবে। প্রবাসীরা মোমবাতির মত এভাবেই নিজেকে জ্বালিয়ে চারপাশটা আলোকিত করে। অতঃপর নিঃশ্বেষ হয়ে যায়।
সফরের মত একজন ভাল পরিবারের সদস্যদের থেকে এমন ধরনের মনোভাব কেউ আশা করেনি। কিন্তু পরিবারের কাছে সফরের লাশটি মূল্যহীন হলেও সে যে মাটির সন্তান তাদের কাছে এই লাশের গুরুত্ব অনেক। বৃহত্তর সিলেট কমিউনিটি প্রবাসী কমিউনিটির মধ্যে সবচেয়ে বড় এবং তাদের ভেতর আত্মিক মিত্রতা ঈর্ষনীয়। এটি সকেলেই মানবেন বলে আমার বিশ্বাস। ওদের আর একটি গুণ হলো, ওরা দানশীল। আমার ব্যক্তিগত পর্যবেক্ষণ। লন্ডনের দিক তাকালে আমরা তা অনেকটাই বুঝতে পারবো। ফান্ড রাইজিং করে ওরা সিলেট বিভাগে অনেক বড় বড় কল্যাণমূলক কাজ করেছে, এখনও করে যাচ্ছে। তো সেই এলাকার সন্তানের লাশটি হাসপাতালের হীমঘরে পড়ে থাকবে? অসম্ভব। বিয়ানীবাজার সমিতি, গোলাপগঞ্জ সমিতি থেকে শুরু করে সিলেট তথা প্রবাসী বাংলাদেশী সকলের আর্থিক সহায়তায় সফর উদ্দীনের লাশটি বাংলাদেশে যাবে, মায়ের কাছে যাবে, সন্তানের কাছে যাবে। প্রবাসীদের কাছে এটিই একটি ভাল লাগার অনুভূতি।
সফর ভাই, আপনি সপ্তাহ কয়েক আগে আমাকে বলেছেন, আপনার কাগজ হয়েছে, পরিবারের সাথে দেখা করতে যাবেন। আসছে মার্চ মাসেই আপনি আপনার পরিবারের সান্নিধ্যে যাবেন। আর মাত্র কয়েকটি দিন। আপনাকে আমি আমার এক বন্ধুর ট্রাভেল এজেন্সিতে নিয়ে গেলাম টিকেটের খোঁজ নিতে। সরাসরি দেশে যেতে পারবেন না, পারিবারিক ও স্থানীয় ঝামেলা আছে বলে আপনি ইন্ডিয়া যাবেন, পরিবার ওখানে আসবে। দীর্ঘদিন পর স্ত্রী-সন্তানদের সাথে মধুর সময় কাটাবেন! যাবতীয় প্রক্রিয়া নিয়ে আলাপ করতে গেলাম আমরা দুজন। আহা, কী উচ্ছাসময় একটি অপেক্ষা! কিন্তু না, সফর ভাই, আপনাকে আপনার পরিবারের সাথে অতদিন অপেক্ষা বা অন্যদেশ হয়ে যাওয়ার প্রয়োজন নেই। আপনার প্রিয় দেশীভাইয়েরা আপনাকে সরাসরি বাংলাদেশে পাঠিয়ে দেয়ার ব্যবস্থা করেছে। আপনার ছোট ভাই আপনার লাশটি গ্রহন করবেন।
আপনার ইচ্ছে-পূরণ হলো, তবে তা অত্যন্ত বেদনাদায়ক পথে। কারন, আপনি আর এই প্যারিস শহরে কোনদিন ফিরে আসবেন না। রেমিট্যান্স আপনাকে আর টেনে নিয়ে আসবে না।
আল্লাহ আপনাকে বেহেশত নসীব করুন।
নাজমুল কবীরের ওয়াল থেকে