1. ph.jayed@gmail.com : akothadesk42 :
  2. admin@amaderkatha24.com : kamader42 :
বৃহস্পতিবার, ২৫ জুলাই ২০২৪, ০৭:০৭ পূর্বাহ্ন

করোনাকালে তরুণদের মানসিক ব্যাধি ও করণীয়

আমাদের কথা ডেস্ক
  • আপডেট : বুধবার, ১৩ অক্টোবর, ২০২১

 

 

লেঃ কর্ণেল নাজমুল হুদা খান:

মানসিক স্বাস্থ্য আমাদের সুস্থতার অন্যতম প্রধান অংশ। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার স্বাস্থ্যের সর্বশেষ সংজ্ঞায় দৈহিক, মানসিক, সামজিক ও আধ্যাতিক সুস্থতার কথা বলা হয়েছে । দক্ষতার সাথে কাজ করার জন্য দৈহিক সুস্থতা গুরূত্বপুর্ন। তবে যথাযথ কর্মশক্তি থাকার পরও মানসিকভাবে সুস্থ না থাকলে কাজের উদ্যম বা চালিকা শক্তি হ্রাস পায়। জীবনের সকল পর্যায়ে বিভিন্ন চাপের সাথে মানিয়ে নেয়া এবং সমাজে ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে পারাকেই মানসিক সুস্থতা বলা হায়।

বর্তমানে করোনার ভয়াবহতা, প্রতিরোধ ও প্রতিকারের কতক বিষয় সব বয়সের মানুষকে বিশেষ করে শিশু কিশোর ও তরুণদের মানসিক ভাবে অসুস্থ করে তুলছে। করোনাকালে এ ভয়াবহ রোগ থেকে মানুষকে মুক্ত করার পাশাপাশি মানসিক স্বাস্থ্যের‌ বিষয়টি গুরুত্বের সাথে বিবেচনার জন্য বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ১০ই অক্টোবর বিশ্ব মানসিক স্বাস্থ্য দিবস-২০২১ উপলক্ষে বিশ্বের সকল দেশকে “Mental health care for all: Let’s make it a reality”- এই প্রতিপাদ্যকে সামনে রেখে কোভিড-১৯ পরিস্থিতিতে মানসিক সুস্থতা নিশ্চিত করতে আহবান জানিয়েছে।

বিশ্ব অতিমারির ইতিহাসে সবচেয়ে ভয়ংকর না হলেও জ্ঞান বিজ্ঞানের উৎকর্ষতায় এ শতকে পৃথিবী নামক এ গ্রহটিকে ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র অনুজীব করোনা ভাইরাস যেভাবে পর্যদূস্ত তুলেছে, তাতে মানুষের অসহায়ত্বই ফুটে উঠেছে। এ পর্যন্ত ২২৩ টি দেশের সাড়ে তেইশ কোটিরও বেশী লোক আক্রান্ত হয়েছে, মৃত্যুবরণ করেছে ৪৮ লাখের উপর।

এ মহামারীতে শিশু কিশোরগন অপেক্ষাকৃত কম আক্রান্ত হলেও মানসিক আঘাতটা সবচেয়ে বেশী এসেছে তাদের উপর। অতিমারি প্রতিরোধে বিভিন্ন দেশে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধের কারনে বিশ্বের ১৬ কোটি শিশু স্কুল জীবন শুরু করতে পারেনি। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খেলাধুলার মাঠ, পার্ক, বিনোদন কেন্দ্র, পারিবারিক অনুষ্ঠানাদি বন্ধ থাকার কারনে ছেলেমেয়েরা মানসিক চাপের ঝুঁকিতে পড়েছে। তরুণ শিশু কিশোরদের মধ্যে মানসিক ভারসাম্যহীনতা, শিক্ষা থেকে ঝরে পড়া, শিশু শ্রম ও বাল্য বিবাহের মতো ঘটনা দেখা দিচ্ছে সারা বিশ্বে; বিশেষ করে তৃতীয় বিশ্বের অনেক দেশ সমূহে।

অতিমারির অনেক বিষয় বুঝতে না পারা, পরিবারের সদস্যদের আক্রান্ত হয়ে আইসোলেশন বা হাসপাতালে ভর্তি থাকা এবং করোনা প্রটোকল মানতে আলাদা আলাদা অবস্থানে থাকা ইত্যাদি শিশুদের মনে বিরূপ প্রভাব রাখে। সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার বিষয়টিও ছেলেমেয়েদের উপর দূর্ব্যবহার, অবহেলা, অনাচারের মাত্রা বাড়িয়ে দেয়। ২০১৪-১৫ সালে পশ্চিম আফ্রিকার দেশ সমূহে ইবোলা মহামারীর প্রাদূর্ভাবের সময় তরুণদের মধ্যে এ ধরনের কর্মকান্ড ও মানসিক ভারমসাম্যহীনতা দেখা যায়।

চীনে ফেব্রুয়ারী ২০২০ সালে লকডাউন চলাকালে শিশুদের উপর পারিবারিক সহিংসতার মাত্রা প্রায় ৪ গুন বেড়ে যায়। যুক্তরাষ্ট্রের টেক্সাসের এক জরিপেও অনুরুপ রিপোর্ট প্রকাশিত হয়। বিশেষ করে তালাক প্রাপ্ত/প্রাপ্তা অথবা আলাদা বসবাসকারী পিতামাতার পরিবারে শিশুদের উপর বকাবকি, মারধর, মানসিক পীড়াদায়ক ঘটনার আধিক্য দেখা যায়। করোনা কালে জার্মানীর এক গবেষনায় মানসিক ব্যাধিতে আক্রান্ত শিশুদের ৬০ ভাগ মানসিক চাপ, একাকিত্ব ও চরম বিরক্তিতে ভুগছে বলে তথ্য উঠে আসে। তারা বলেছে বন্ধুদের সাথে মিশতে না পারা, পরিবারের সদস্যদের সাথে না থাকা, পছন্দের খেলাধুলা ও শখের কোন কাজে অংশ নিতে না পারা, পারিবারিক কলহে জড়িয়ে পড়া, মা-বাবার সাথে বিভিন্ন বিষয়ে দ্বন্দ, ঘরের বাহিরে বের হতে না পারা, প্রাত্যাহিক রুটিন অনুসরণ ও স্কুলের হোম ওয়ার্ক না করা , করোনা আক্রান্তের ভয়, স্ক্রীন টাইম বাড়াতে বকাবকির স্বীকার হওয়া ইত্যাদি কারনে সবসময় শিশুরা মানসিক চাপে থাকছে।

অপেক্ষাকৃত তরুণ ছেলেমেয়েদের মধ্যে রুক্ষ ব্যবহার, নিদ্রাহীনতা, মানসিক চাপ, হতাশা, দুঃখবোধ, নিজের উপর নিয়ন্ত্রনহীনতা, করোনা আক্রান্ত পরিবারের সদস্যদের থেকে পৃথক থাকার কষ্ট বা মানসিক দুঃখবোধ ইত্যাদি উপসর্গ দেখা যায়। উঠতি বয়সী তরুণদের মধ্যে মূলত হতাশা, সহজে নার্ভাস হয়ে পড়া, স্মৃতিকাতরতা লক্ষ্য করা যায়। পূর্বে থেকে মানসিক সমস্যায় আক্রান্ত ছেলে মেয়েদের মধ্যে করোনা কালে বিভিন্ন কারনে পারিবারিক অবহেলার জন্য হতাশা, দূশ্চিন্তা ও মানসিক চাপ আরও ঝেঁকে বসে। কোভিড-১৯ সন্দেহে কোয়ারেন্টাইন বা আইসোলেশনে থাকা ছেলে মেয়েদের মধ্যে দুশ্চিন্তা, অহেতুক ভীতি, সামাজিক কুসংস্কার ও হতাশা প্রভৃতি মানসিক বৈকল্য দেখা দেয়।

যুক্তরাষ্ট্রের এক জরীপে তরুণদের প্রায় অর্ধেক করোনা কালে শারিরীক নির্যাতন এবং আটজনে একজন মানসিক অত্যাচারের স্বীকার হয়েছে। বাংলাদেশে এক গবেষনায় প্রায় ৩০% ছেলেমেয়ে হতাশা , দুশ্চিন্তা কিংবা মানসিক চাপে ভোগার তথ্য পাওয়া যায়। বেশ কিছু জরীপে করোনা কালে শিশুদের মধ্যে মানসিক অসু¯’তার হার বৃদ্ধির তথ্য পাওয়া যায় যেমনঃ ঘুম বা ক্ষুধার পরিবর্তন, নিজের পছন্দের কাজ বা শখের প্রতি অনাগ্রহ, পরিবারের অন্যদের কাছ থেকে বি”িছন্ন হয়ে পড়া, আবেগের বিরূপ প্রকাশ, স্বাভাবিক আচরনে পরিবর্তন, দৈনন্দিন বিষয় বা জরুরী ইস্যুগুলো ভুলে যাওয়া , স্ক্রীন টাইম অস্বাভাবিক ভাবে বেড়ে যাওয়া, ইটারনেট বা ইলেকট্রিক গেজেটে আসক্তি বেড়ে যাওয়া ইত্যাদি প্রধান।

শতাধিক দেশের জরীপে দেখা গেছে করোনা কালে শিশু কিশোরদের টীকাদান ও স্বাস্থ্য সেবা ৩০% কমে গেছে । পুষ্টি সেবায় ৪০% হ্রাস, ২৫ কোটি শিশু স্কুল টিফিন থেকে বঞ্চিত হওয়া ও শিশু ভিটামিন এ ক্যাপসুল কর্মসূচী থেকে বাদ পড়াসহ বিশ্বব্যাপি শিক্ষা, স্বাস্থ্য, পুষ্টি, স্যানিটেশন, খাবার পানি প্রভৃতি সুবিধা থেকে বঞ্চিত হয়েছে। সুতরাং করোনা কালে এসব ঘাটতি তরুণদের মধ্যে মানসিক অসুস্থতার প্রকোপ বাড়তে নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে।

বাংলাদেশও প্রাপ্ত বয়স্কদের মধ্যে প্রায় ১৭% বা ২ কোটি লোক এবং তরুণদের মধ্যে প্রায় ১৮% বিভিন্ন ধরনের মানসিক রোগে ভুগছে। করোনা কালে এ হার অন্যান্য দেশের মতো আমাদের দেশেও বেড়ে গেছে বলে প্রমান মিলেছে। অঞ্চলভেদে এর তারতম্য প্রায় ৭%-৩০% পর্যন্ত দেখা যায়। নারীদের আক্রান্ত হওয়া এবং ঝুঁকি দু’টোই বেশি। বস্তি এলাকার তরুণদের মধ্যে মানসিক ব্যাধিতে আক্রান্তের সংখ্যা উল্ল্যেখযোগ্য হারে বৃদ্ধি পরিলক্ষিত হয়। এক কথায় আমাদের দেশের প্রায় আড়াই কোটি মানুষ কোন না কোন মানসিক সমস্যায় ভুগছে।
করোনা অতিমারির বর্তমান পরিস্থিতি ৩২ টি দেশের প্রায় ৪ লাখ মানুষের উপর গবেষনায় কোভিড-১৯ পরবর্তি মানসিক অবস্থার বেশ অবনতির প্রমান পাওয়া যায়। এক গবেষনায় ২৮ ভাগ মানুষের হতাশা , ২৭ শতাংশের মধ্যে দুশ্চিন্তা, ৩৭ ভাগের মধ্যে মানসিক চাপ এবং প্রায় ২৮ ভাগ মানুষের নিদ্রাহীনতা দেখা যায়।

পৃথিবীর প্রায় ৮০০ মিলিয়ন মানুষ বিভিন্ন ধরনের মানসিক ব্যাধিতে ভুগে থাকে। মানসিক ব্যাধিতে আক্রান্ত ৯০ ভাগই চিকিৎসার আওতার বাইরে থেকে যায়। তরুণদের মধ্যে এ প্রবনতা আরো বেশি। মানসিক সমস্যা তারা শেয়ার করতে চায়না, এমনকি পরিবারের ঘনিষ্টদের সাথেও। এ ব্যাপারে সচেতনতার অভাব রয়েছে প্রায় ৭০ শতাংশের মধ্যে।

শিশু, কিশোর ও তরুণদের মানসিক অসুস্থতা প্রতিরোধ ও ব্যবস্থাপনায় সুনির্দিষ্ট গাইডলাইন প্রনয়ন করেছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এবং ইউনিসেফ। নির্দেশিকায় বলা হয়েছেঃ

– তরুণদের কোভিড-১৯ প্রতিরোধে স্বাস্থ্য বিধি মেনে চলা, নিরাপদ দূরত্ব বজায় রাখা, ব্যক্তিগত পরিছন্নতা নিশ্চিত করতে হবে। পরিবারের কেউ আক্রান্ত হলে আতংকিত না হয়ে শিশু-কিশোরদের সাহস জোগাতে হবে। তারা আক্রান্ত হলে নীতিমালা অনুসরণ করে যথাযথ চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে হবে। কোয়ারেন্টাইনে থাকলে তাদেরকে সাথে সময় দিতে হবে এবং রোগ প্রতিরোধ বিষয়ে সচেতনতার শিক্ষা দিতে হবে।

– ভীতিকর খবরাখবর প্রচারের সময় টেলিভিশন বন্ধ রাখতে হবে। কোভিড-১৯ সংক্রান্ত আলাপ আলোচনা সীমিত রাখতে হবে। মিডিয়ায় মহামারীর খবরাখবরের দিকে বিশেষ মনযোগ না দিয়ে ভালো খবর দেখার বা শোনার উৎসাহ দিতে হবে।

– ছেলে মেয়েদের স্ক্রীন টাইমের প্রতি নজরদারী রাখতে হবে। ভিডিও গেম বা স্ক্রীন কার্যক্রমের বিষয়বস্তু সম্পর্কে তাদের সাথে কথাবার্তা বলা যেতে পারে। তাদেরকে কম্পিউটার, স্মার্টফোন ইত্যাদির সাথে সময় কাটানো হ্রাস করতে হবে। তবে উঠতি বয়সী তরুণদের আতœীয় স্বজন ও বন্ধুদের সাথে ভিডিও বা টেলি কনফারেন্সিং ও ভিডিও চ্যাটিং এ উৎসাহিত করা যেতে পারে ।

– পরিবারের রুটিন কাজের সাথে তাদের অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। রান্না বান্নার কাজে তাদের সহযোগীতা নেয়া যেতে পারে। তাদের কাছে বসিয়ে আদর যতেœর সাথে কথাবার্তা গল্প বা তাদের কথা শুনতে হবে। মনের কষ্ট বেদনা শেয়ার করার পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে। স্বাস্থ্য বিধি মেনে জন্মদিন উৎসব ও পারিবারিক আড্ডা আয়োজন করা যেতে পারে।

– বই পড়া , ছবি আঁকা ও বিভিন্ন ধরনের ইনডোর খেলাধুলায় মনযোগী করার চেষ্টা করতে হবে।
– ঘুমের রুটিন নিশ্চিত করতে হবে। প্রাত্যাহিক রুটিন অনুসরণে সচেতন করে তুলতে হবে ।

কোভিড-১৯ যুদ্ধকালীন সময়ে তরুণদের মানসিক অসুস্থতা ও অস্থিরতাই বাস্তবতা । এ বিষয়টি উপেক্ষা করলে তরুণদের উপর দীর্ঘ মেয়াদী নেতিবাচক শারিরিক ও মানসিক প্রভাব পড়তে পারে। এক্ষেত্রে পরিবারের প্রাপ্ত বয়স্ক সদস্য, বিশেষ করে বাবা মায়ের গুরুত্বপূর্ন ভুমিকা রয়েছে । করোনাকালে পিতামাতাকে নিজেদেরকে সুস্থ রাখা এবং পরিবারের ছেলেমেয়েদের মানসিকভাবে সুস্থ রাখতে সদা সচেষ্ট থাকতে হবে।

লেঃ কর্ণেল নাজমুল হুদা খান, এমফিল, এমপিএইচ
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ
সহকারী পরিচালক, কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতাল, কুর্মিটোলা ঢাকা।
ই-মেইলঃ nazmul29@yahoo.com

নিউজটি শেয়ার করুন

এই জাতীয় আরো খবর
© সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত । এই ওয়েবসাইটের কোনো লেখা, ছবি, ভিডিও অনুমতি ছাড়া ব্যবহার বেআইনি।
Maintained By Macrosys